ধরিয়া প্রমাণ করতে হবে মারেন নাই

প্রভাষ আমিন
৯৫ দিন লন্ডনে থেকে দেশে ফিরে নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে হঠাৎ ঢেউ তুললেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি চিকিৎসা ও ব্যক্তিগত কাজে লন্ডন গেলেও ফেরার পর তাঁকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেন গণসংবর্ধনা তার কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও নগরবাসীকে অসহনীয় যানজট উপহার দিয়েই দেশে ফিরেছেন বেগম জিয়া। অবশ্য দেশে ফেরার সময় নগরবাসীকে যানজট উপহার দেয়ার কৃতিত্ব বেগম খালেদা জিয়ার একার নয়। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিউইয়র্ক থেকে ফিরে গণসংবর্ধনা নিয়েছেন।

দেশে ফিরে খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। তারপর গেছেন টেকনাফে, রোহিঙ্গাদের দেখতে। এই দেখতে যাওয়া নিয়েই যত উত্তাপ। চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে বেগম জিয়ার গাড়িবহরে অন্তত চার দফা হামলা হযেছে। গাড়ি ভাংচুর হয়েছে। সাংবাদিকসহ অনেকেই আহত হয়েছেন। এই হামলা নিয়েই এখন চলছে পাল্টাপাল্টি কথার বাণ। বিএনপি হামলার জন্য সরকারি দলকে দায়ী করেছে। আওয়ামী লীগ দায়ী করেছে বিএনপির অন্তর্দলীয় কোন্দলকে।

সরকারি দলের নেতারা বলছেন, বেগম জিয়া আকাশপথে না গিয়ে সড়কপথে কক্সবাজার গেলেন কেন? সরকারি দলের নেতাদের এই প্রশ্নে যুক্তি না থাকলেও বাস্তবতা আছে। জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের কেউ এখন আর সড়কপথে কক্সবাজার যান না। আর খালেদা জিয়া নিজেও কিছুটা অসুস্থ। মাত্র লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। তাই তার আকাশপথে কক্সবাজার যাওয়াটাই স্বাভাবিক হতো। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, বেগম খলেদা জিয়া এই পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনীতি করতেই তিনি সড়কপথে কক্সবাজার গেছেন।
খুব সত্যি অভিযোগ। কিন্তু দেশের একটি বড় দলের চেয়ারপারসন যে কোনো ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করতেই পারেন, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করাও অপরাধ নয়। তাই খালেদা জিয়া আকাশপথে কক্সবাজার গেলেই সরকারের জন্য সুবিধা হতো। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া তো সরকারি দলের সুবিধা দেখবেন না। তিনি তাঁর সুবিধাটাই দেখবেন।

আর বেগম জিয়া আকাশপথে যাবেন, না সড়কপথে যাবেন; সেটা তাঁর ইচ্ছা। সরকারের দায়িত্ব শুধু বেগম খালেদা জিয়া নন, সকল নাগরিকের নির্বিঘ্ন নিশ্চিত করা। সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার প্রসঙ্গ এলেই সরকারি দলের নেতারা বিএনপি কী কী করেছে, শেখ হাসিনার ওপর কতবার হামলা হয়েছে; তার ফিরিস্তি দেন।

এটা ঠিক এ ধরনের অপকর্ম বিএনপিও কম করেনি। এমনকি আহত হুমায়ুন আজাদকে দেখতে সিএমএইচে যেতে গিয়েও বাধার মুখে পড়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জীবন সবসময়ই ঝুঁকির মুখে।

দেশের বাইরে থাকায় পচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গেলেও হারিয়েছেন পরিবারের সবাইকে। ৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৯ বার হত্যাচেষ্টা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা। এমনকি শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর জনসভায় গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিল পুরো রাষ্ট্রশক্তি। শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার একটির রায় হলো রোববার। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির দুর্বৃত্তরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায়।

পচাত্তরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতেই এ হামলা চালিয়েছিল ফ্রিডম পার্টি। সবার দোয়ায় বেঁচে গেছেন শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও বিচার চলছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ওপর হামলা হয়েছে বলেই বেগম জিয়ার গাড়িবহরে হামলা জায়েজ হয়ে যায় না। একটা অন্যায় কখনোই আরেকটা অন্যায়ের যুক্তি তৈরি করতে পারে না। বিচার হতে হবে সব অন্যায়ের।

আগেই বলেছি বেগম খালেদা জিয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়ার ফাকেঁ এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছেন। এমনিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামার সুযোগ পান না। দেশে ফেরার দিন বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে গিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার ঢাকা টু কক্সবাজার পরিভ্রমণে বেগম জিয়া কোথাও বক্তৃতা দেননি বটে, তবে তার এই সফরকে ঘিরে গোটা চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপির নেতাকর্মীরা দারুণ উজ্জীবিত হয়েছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে বেগম জিয়া এখন এ ধরনের গণসংযোগের সুবিধা নিতেই চাইবেন। এটাতে তো দোষের কিছু নেই। বরং বেগম খালেদা জিয়া পেট্রোল বোমার রাজনীতিকে অতীত করে মাঠে নামছেন; গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটা ইতিবাচকই।

কিন্তু ইতিবাচক ধারায় বাধ সেধেছে দুর্বৃত্তরা। সেই দুর্বৃত্ত কারা? বিএনপি বলছে, হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির অন্তর্দলীয় কোন্দল। আমরা কোনটা বিশ্বাস করবো? আমরা দুটিই বিশ্বাস করে বিশ্লেষণ করতে পারি। প্রথম কথা হলো, এ ধরনের হামলায় কার লাভ, কার ক্ষতি?

লাভ পুরোটাই বিএনপির। কারণ হামলার কারণে বেগম জিয়ার কক্সবাজার যাত্রা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর ক্ষতি পুরোটাই সরকারের। তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। তাহলে সরকারি দল নিজেরা হামলা করে, কেন নিজেদের ক্ষতি করবে? আর যতদূর জানি, ঢাকা থেকে নেতাকর্মীদের নিবৃত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবসময় কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে চলে এমন নয়।

অতি উৎসাহীরা প্রায়শই এমন সব কাণ্ড-কারখানা করেন, যাতে দলের ও সরকারের বদনাম হয়। আর ফেনী অনেকদিন ধরেই নিজামউদ্দিন হাজারির সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যে নাকি তার ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তো সেই সাম্রাজ্যে বিএনপির অন্তর্দলীয় কোন্দলে কার সাহস হলো বেগম খালেদা জিয়ার বহরে হামলা চালিয়ে সরকারের বদনাম করার? তাই আমরা কারো কথাই অবিশ্বাস করছি না, আবার কাউকে বিশ্বাসও করছি না।

পুলিশের প্রথম দায়িত্ব ছিল খালেদা জিয়ার বহর নির্বিঘ্ন করা। সে দায়িত্বে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তাদের দায়িত্ব হলো হামলাকারীরা যে দলেরই হোক খুঁজে বের করা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন, পত্রিকা এবং অনলাইনে হামলাকারীদের ছবি ছাপা হয়েছে। ফেনী একটি ছোট্ট শহর। ছবি দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা ওয়ান-টুর ব্যাপার হওয়ার কথা।

হামলাকারীদেরে রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেই করুক, তারা সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। কাদম্বনীকে যেমন মরিয়া প্রমাণ করতে হয়েছিল তিনি মরেন নাই। তেমনি হামলাকারীদের ধরিয়া সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তারা মারেন নাই, হামলা করেন নাই।

প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, ৩০ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ