এই লেখাটি বিএনপির বিবেচনার জন্য

আনিস আলমগীর
রাজনীতির আকাশে পুনরায় একটা দুর্যোগের আভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। খবর অনুসারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য তারা আন্দোলনেও যাবে।

আওয়ামী লীগ সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুসরণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছে। তারা শাসনতন্ত্র সংশোধন করে পুনরায় অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসবে কেউ বিশ্বাস করে না। আর গত চার বছর ধরে বিএনপি দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য বিলুপ্তির পর কোনো জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এদেশে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করা না হলে শাসনতন্ত্র সংশোধনের মতো কোনো ঘটনা ঘটানো যায় না।

বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আনতে গভীর রাত পর্যন্ত সংসদ চালিয়ে শাসনতন্ত্রের সংশোধনী এনেছিলেন বাধ্য হয়ে। মাগুরার উপ-নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ-জামায়াতসহ সব বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন করেছিলো এবং সে আন্দোলন জনপ্রিয় আন্দোলন ছিলো।

যে কোনো আন্দোলন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাঝে গড়ে উঠে। বিএনপি সে প্রতিক্রিয়ার ধারে কাছেও থাকে না। হঠাৎ করে আন্দোলনে আসলে মানসিক প্রস্তুতিহীন মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয় না। তখন আন্দোলন স্বাভাবিক পথ ছেড়ে সন্ত্রাসের পথ ধরে।

আগুন দেয়া, রেলের লাইন তুলে ফেলা, মানুষ হত্যা করা- সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না। আন্দোলনকারী দল যখন সাধারণ মানুষের অপছন্দের পথে পা বাড়ায় তখন সরকার আন্দোলন বানচাল করতে কঠোর পথে অগ্রসর হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর বিএনপি যে কঠোর আন্দোলন করেছিলো তা সফল হয়নি শুধুমাত্র এই কারণে।

বিএনপি নেত্রী লন্ডনে বলেছিলেন ২০১৩ সালের শেষ চার মাস তিনি কঠিন আন্দোলন করেছেন। কথা সত্য। কিন্তু সরকার ছিলো আওয়ামী লীগের। তাদের সংগঠন ছিলো মজুবত এবং রাজনীতি আন্দোলন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিলো সমৃদ্ধ। সুতরাং তাদের সঙ্গে পেরে উঠা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ১৯৯৬ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন করে বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাশ করে ৪৫ দিনের মাথায় চলে যেতে হয়েছিলো আর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি ঠিক তেমন নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগ পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকে রয়েছে।
বিশ্বে কেউ শেখ হাসিনার সরকারকে অচ্ছ্যুৎ মনে করলো না। বাংলাদেশে সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলনের আরো একটা মূখ্য বিষয় বিবেচনায় আনতে হয়। তা হচ্ছে সরকারী প্রশাসন অর্থাৎ পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, আর সিভিল প্রশাসন এর সহানুভূতি কোন দিকে। তারা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে সহজে সরকারকে আন্দোলন দিয়ে কাবু করা যায় না।

১৯৯০ সালের আন্দোলনে জেনারেল এরশাদের সরকারকেও ফেলে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। যদি সেনাপ্রধান জেনারেল নূরুদ্দীন সমর্থন প্রত্যাহার না করতেন। বেগম জিয়ার অবস্থান দুর্বল করে দিয়ে ছিলো জনতার মঞ্চ। জনতার মঞ্চে তো সচিবালয়ের সব-অফিসার আর কর্মচারীরা ভেঙ্গে পড়েছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন বাহিনীর বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ যে সুযোগ সুবিধা দিয়েছে সেটি বিগত সরকারগুলোর তুলনায় বিরল।

আবার প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকাকেও খেয়াল রাখতে হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিএনপিকে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সর্বোপরি দেশে এখন দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী উপস্থিত। তাদেরকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। যতক্ষণ সম্মানজনকভাবে তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারে ততক্ষণ তাদেরকে রাখতে হবে। ১০ লক্ষ লোকের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা, থাকার, চিকিৎসার বন্দোবস্তু করা -বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের জন্য খুবই কঠিন ব্যাপার।

আবার উত্তরবঙ্গের ৩০/৩২ জেলায় বন্যা হয়ে গেল। সেখানে আমন আউশ সবই শেষ। অধিক বৃষ্টির কারণে দেশের ৬০% শতাংশ রাস্তাঘাট বিপন্ন হয়ে গেছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হয়ে গেলে যুদ্ধ উত্তর সময়ের মতো কাজ আরম্ভ করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি হরতাল দেয় অথবা অবরোধ কর্মসূচী দেয় তবে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে।

দেশে এখন খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে। সরকার ১১ লক্ষ টন খাদ্য জরুরী ভিত্তিতে আমদানী করছে। সে খাদ্য সমগ্র দেশের সর্বত্র নির্বিঘ্নে পৌঁছাতে হবে। গত ২০১৩ সালের শেষ চার মাসের আন্দোলনে ৩১৯ জন লোক জামাত-বিএনপির কর্মীদের বোমায়, বাসে অগ্নি সংযোগের কারণে নিহত হয়েছে। আবার ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি হতে ৯৩ দিন যে আন্দোলন হয়েছে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের আঘাতে ১৫২ জন মানুষ নিহত হয়েছে, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে শত শত মানুষ। এরা ছিলো সাধারণ মানুষ। বিএনপির ক্ষমতার লড়াইয়ে এদের মৃত্যু হলো। এ নিরাপরাধ, নির্বোধ মানুষগুলোর অভিশাপ কি কাউকে না কাউকে ভোগ করতে হবে না?

মানুষের সব কাজের মূল হচ্ছে সুখের আকাঙ্ক্ষা। মানুষের সব কাজ, কাজ নয়। আবার সব সুখ, সুখও নয়। মানুষ হত্যা করে সুখের আকাঙ্ক্ষা খুবই নির্মম আকাঙ্ক্ষা। বিএনপিকে অনুরোধ করব রাজ্য জয়ের জন্য আবার যেন অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন না করে।

ভারতের পররাষ্টমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক সময়ে বৈঠকের সময় তারা নাকি নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিলেন আর সুষমা স্বরাজ বলেছেন যে, যে ব্যবস্থা আমার দেশে নেই সে ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করি কীভাবে! ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যবস্থায় নির্বাচনের সময় প্রচলিত সরকারই অন্তবর্তী সরকার হয়।

যে কোনো অবস্থায় বেগম জিয়ার উচিৎ কোনো কিছুর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া, এমনকি মামলার কারণে তার নিজের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হলেও। এছাড়া অন্য কোনো পথে হাঁটতে গেলে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

গত দুই আন্দোলনের শত শত মামলার বেড়াজালে আটকা আছে শত শত কর্মী। বিএনপি তাদের কোনো আইনী সহায়তা পর্যন্ত দিতে পারেনি। শত শত কর্মী এখনও আটক আছে বলে বিএনপি দাবী করে। অনুরূপ পরিস্থিতিতে পুনরায় আন্দোলনে যাওয়া বিএনপির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। আর কোনো কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচন বিএনপিকে ছাড়া যদি অনুষ্ঠিত হয়ে যায় তবে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীগোষ্ঠী বিকল্প খুঁজে বেড়াবে।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি, মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাপ মোজাফফর, মুসলিম লীগ, খন্দকার মুশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগসহ বহুপার্টি- হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা, না হয় ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন দেখতে পাচ্ছি সমস্যা সমাধানে বিএনপি সম্ভবত ভুল পথে এগুচ্ছে। বিএনপি এখনও এর পুরো অভিঘাত বুঝতে পারছে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণই হতে হবে বিএনপির শেষ সিদ্ধান্ত।

আনিস আলমগীর: সাংবাদিক ও শিক্ষক।
anisalamgir@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, ২৮ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ