জয়নাল আবেদীন
প্রিয় মুশফিক,
ক্রিকেটের আকাশে হাজারো তারা। আমার চোখের তারা তুমি। বাইশ গজে আমাদের সোনার ছেলেরা এখন দুরন্ত। তবুও তোমার ব্যাটেই ভরসা খুঁজি আমি। কদিন ধরে তুমি ঠিক নিজের মধ্যে নেই বলে আমিও যেন হারিয়ে যাই আমার থেকে।
সেই রাতে ঠিক তোমার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তুমি নিরাশ করোনি। তোমার ব্যাটে যখন পরপর দুটো চার এসে গেলো, অমনি আমি লাফিয়ে উঠি। দোকানভর্তি অগণিত মানুষ। অথচ সবচেয়ে বেশি খুশি আমিই। তোমরা ইতিহাস তৈরি করবে, আর ক্রিকেটের এই পাগলটি খুশি হবে না- তা কী করে হয়? আমোদটা যে মিনিট দুয়েকের বেশি টেকেনি! পরের বলটি যেভাবে উড়িয়ে মারলে সেটি তো শিখর ধাওয়ানের তালুবন্দি হয়নি; কাঠের বলটি এসে ঠেকেছে আমার বুকের পাঁজরে।
এরপর যখন মাহমুদউল্যাহও তোমার মতো করে তোমারই ভঙ্গিতে বলটি আকাশে উড়িয়ে দিলো, সেটিও এসে ভেঙে দিয়ে গেলো আমার বুকটা। আমার হৃদয়টা ছটফট করতে লাগলো। ডান হাত দিয়ে চেপে ধরেছি। তবু টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাইনি। পাশে লোকগুলোর বারণও শুনিনি। শেষ বলে ১ রানের পরাজয় আমার ছটফট করা হৃদয় আরো দুমড়ে-মুছড়ে দিয়ে গেলো!
তুমি হয়তো বুঝতেও পারবে না আমি কতটা খেলার ঘোরে ছিলাম। একটি বারের জন্যেও মনে পড়েনি, কুঁড়েঘরে পথচেয়ে বসে আছে আমার জীবনসঙ্গী। বাবার আদর পেতে তখনো ঘুমায়নি ছোট্ট সায়েম। শরীফ-সুইটি তখনো বাবার প্রতীক্ষায়। যেই-ই বুকটা মোছড় দিয়ে ওঠে, অমনি ওদের একেকটি ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। বুক চেপে ধরেই ছুটে চলি বাড়ির পথে।
উঠানে গিয়ে রাশেদার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকি। তখনো ঘরের মেঝেতে পা দিইনি। আমার চলার শক্তি যেন সব ক্ষয়ে যেতে থাকে। মাত্র নয় মাসের ফুটফুটে বাচ্চাটি তখনও কান্নায় সারা ঘর ভারী করে তোলে। আমার শরীফ, সুইটিকে বুকে টেনে ধরি। ওদের জন্য আমার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
এরপর বুকের ভেতরে অস্থিরতা শুরু হলো। রাশেদা আমার মুখে জল ঢেলে দিলেও সেটি ভেতরে যায়নি। সবই গড়িয়ে পড়েছে আমার গাল বেয়ে। সেই জলের সঙ্গে অশ্রু মিশে তখন একাকার। এমন এক করুণ পরিণতি আমাকে আর তোমাদের মাঝে থাকতে দেয়নি। আমি এখন এপারের লোক; যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।
এপারে এসেই আমার এখন মনে পড়ছে, সেই বিকেলে আমার ছেলেটি বলেছিল- বাবা, আমার গণিতের খাতা শেষ। মেয়েটি বলেছিল- আব্বু, আমার জন্য সুন্দর দেখে পেন্সিল নিয়ে এসো।
আমি কী করে ছেলের অংকের খাতা নিয়ে যাব? মেয়ের জন্য রঙ-বেরঙের পেন্সিলই বা নেব কী করে? ওদের এখন কী হবে? ওরা পড়তে পারবে? খেতে পারবে? শুধুই আফসোস! আমার নয় মাসের সায়েমের মুখ থেকে বাবা ডাকটিও শুনতে পেলাম না। যার বাবা নেই, সে কী আর বড় হয়ে বাবা ডাক শিখতে পারবে?
পারবে না। হয়তো একবুক শূন্যতা আর হাহাকার সঙ্গী করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে। হয়তো কোন একদিন জানতে পারবে, এ দেশের ক্রিকেটের প্রতি নিখাদ ভালোবাসাই তার বাবাকে নিয়ে গেছে জীবনের ওপারে।
ক্রিকেটের প্রতি আমার এই ভালোবাসা আজকের নয়। তবে ঠিক কখন থেকে এই টান, সেটিও বলতে পারব না। খুব একটা পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। তারপর মাকেও। এরপর নেমে পড়তে হয়েছে জীবনযুদ্ধে। এই যুদ্ধ অনেক কঠিন।
খবরের কাগজে চোখ বোলাতাম সেই ছোটো থেকেই। আমার বাড়ির পাশেই বাজার। সেলুন দোকানে যে পত্রিকাটি রাখতো, কাজে যাবার সময় এক ফাঁকে খেলার পাতাটি দেখতামই। কাজ সেরে রাতে গিয়ে খুঁটে খুঁটে পড়তাম ক্রিকেটের সবগুলো খবর।
পাড়ায় যখন কোনো টুর্নামেন্ট হয়, আর সেই টুর্নামেন্টে যদি একজন মাত্র দর্শক থাকে, সেই লোকটি আমি। শুধু খেলা দেখবো বলেই কতদিন কাজে যাইনি। একদিন কাজে না গেলে বউ-ছেলে-মেয়েকে উপোষ থাকতে হতো। তবু খেলার প্রতি ভালোবাসা আমাকে কখনো কখনো ওদের থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দিতো।
আমার জীবনটি কষ্টেই গড়া। দিন বদলানোর কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মানুষ যায় কাতারে, কুয়েতে কিংবা দুবাইতে। সেই সুযোগ আমার হয়নি। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছিলো পাকিস্তান। তবুও জীবন বদলায়নি। অশান্তির আঁতুরঘর থেকে কী আর কারো জীবন বদলানোর মন্ত্র পাওয়া যায়?
প্রিয় মুশফিক,
মনে পড়ে চার বছর আগের সেই রাতের কথা? তখন আমি করাচিতে। যেখানে থাকতাম, তার পাশেই অনেক মানুষ একত্রে এশিয়া কাপের সেই ফাইনাল ম্যাচটি দেখছিলাম। আমরা মাত্র কয়েকজন বাঙালি। ওদের মুখের ওপর কোনো কথাই বলতে পারিনি সেদিন। সেদিনও বাইশ গজে তুমি ছিলে অকুতোভয়। তোমাদের নৈপুণ্য দেখে আমি সেদিন লাফিয়ে উঠতে পারিনি ওদের ভয়ে। সেই রাতটিও আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নেরই ছিলো। হতে হতেও হলো না মাত্র ২ রানের জন্য।
তার কিছুদিন পরই পাকিস্তান থেকে আমি দেশে ফিরি। এসেই আবার পুরোনো পেশায়। গ্রামে কাজের অভাব নেই। কোনো না কোনো কাজ জুটেই। মজুরি দিয়েই চলে যেত সংসার। দুটো ছেলে-মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে, থ্রি এবং টুতে। অনেক আশা ছিলো, তিন সন্তানকেই পড়াশোনা করিয়ে সত্যিকারের মানুষ করবো।
বাবা-মাকে হারিয়ে আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। সেই শিক্ষা থেকে শপথ নিয়েছিলাম, নিজের অপূর্ণতা সন্তানদের দিয়েই পূরণ করবো। কিন্তু দেখো, নিয়তি কতটা কঠিন! আমার মতো আমার তিনটি সন্তানকেও বাবাহীন করে দিলো!
আমি একজন সাধারণ দিনমজুর ছিলাম। কখনো ভাবিনি, সামান্য আয় দিয়ে এই সংসারটিকে আমিই বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। এখন যখন ওদের ছেড়ে এপারেই চলে এসেছি, বুঝি- বাবা ছাড়া সন্তানেরা নিষ্প্রাণ। এখন বুঝি, স্বামীই হলো স্ত্রীর অলংকার।
ক্রিকেটের প্রতি আমি এতটা বিভোর হয়ে পড়েছিলাম যে, স্বামী হিসেবে স্ত্রীর এবং বাবা হিসেবে সন্তানদের প্রতি দায়িত্বটা ভুলে গিয়েছিলাম। জানি না, এর ক্ষমা হয় কি না। তুমি পারবে না, আমার দায়িত্বটা তোমার কাঁধে তুলে নিতে? বেশি কিছু নয়, আমার তিনটি মাছুম বাচ্চাকে মানুষ করে দিতে? পারবে না?
[নোট : বাংলাদেশ-ভারতের সেই শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে এক রানের পরাজয় সইতে না পেরে মিরসরাইয়ে আবুল কাশেম নামে চল্লিশোর্ধ এক দিনমজুর মারা যান। তাঁর রেখে যাওয়া স্ত্রী-সন্তানদের জীবন নিশ্চিত অন্ধকারে। সেই দিনমজুরের মনের ভেতরে ঢুকে গভীরের কথাগুলো তুলে ধরা হলো এই চিঠিতে]
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, ০৯ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম