আত্মার গান

মোঃ দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা
আমরা বাঙালি জাতি। সংস্কৃতির ভিতরেই আমাদের বেড়ে ওঠা। যুগ যুগ ধরে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ আমরা। আর সম্প্রীতির বন্ধনের বাহন হচ্ছে গান। গান হচ্ছে মানুষের আত্মার খোরাক, মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে গান। আমরা কারণে অকারণে গুণগুণিয়ে গান গাই। মনের অজান্তেই গান চলে আসে। সুর বেসুর সেটা কোন বিষয় না, মনে ভাল লাগে তাই গান আসে।

যারা মাঠে কাজ করে তারা কাজ করতে করতেই মনের সুখে গান ধরে। সে গানের সুর বাতাসে ভেসে যায় দূর থেকে বহুদুর। গানের মধ্যে কি যে করুণ সুর বেজে ওঠে তা নিজ কানে না শুনলে অনুধাবন করা যাবে না। সে গান হতে পারে বাউল গান, হতে পারে মুর্শিদী গান, মারফতি, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতিসহ অসংখ্য গান। যা বাংলার লোক সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। আবার যখন তপ্ত দুপুরে নদীর ধারে কোন বটের ছায়ায় বা নির্জন রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিক যখন বিশ্রাম নেয় ঠিক তখনও গানের সুর ভেসে আসে কানে। এ গান আত্মার গহীন থেকে চলে আসে।
সাধারণত জীবনের সাথে মিশে একাকার হয়ে যে গানগুলো মানুষের মুখে মুখে চলে আসে সে গানগুলোর মধ্যে বাউল গানই বেশি শোনা যায়। আমাদের লোক সঙ্গীতের একটি বড় অংশই দখল করে আছে এই বাউল গান। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান এই বাউল গান। যে গান জীবনের কথা বলে, যে গান সুখ দুঃখের কথা বলে, যে গান মানবতার কথা বলে, যে গান সৃষ্টিকর্তার কথা বলে, যে গান হৃদয়ের দহন উগ্রে দেয় সেই গানই হচ্ছে বাউল গান, আত্মার গান।

মানব প্রেম আর ঈশ্বরের প্রেম বাউল গানের মূল বিষয়বস্তু। না পাওয়ার বেদনা করুণ সুরে উপস্থাপন করা হয় এই গানের মাধ্যমে। ভালবাসার মানুষকে না পাওয়া বা চিরতরে হারিয়ে পথে পথে বৈরাগী হয়ে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে আত্মার সুখ খোঁজে বাউলরা। তাদের সুর প্রিয় হারানো মানুষের কাছে অমৃতের মত মনে হয়।
বাংলায় বাউল গান আনুমানিক পঞ্চদশ শতকে কিংবা তারও আগে থেকে। তবে আমার কাছে মনে হয় যখন থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল ঠিক তখন থেকেই এই বাউল গানের জন্ম হয়েছিল। সেটা হতে পারে পাল বংশের শাসনামলের শুরুর দিক থেকে। কারণ অনেক ভাষাবিদদের ধারণা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছিল। তবে বাউল গান শুধু বাংলাতেই সৃষ্টি হয়নি। এই বাউল গানের প্রচলন বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে তার মধ্যে ইরান, ভারতে, পাকিস্তান, আফগানসহ অন্যান্য দেশে। বাউল গানের সাথে সুফিবাদের একটা যথেষ্ঠ মিল রয়েছে।

বাংলায় বাউল শব্দটি প্রথমে লক্ষ্য করা যায় মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে। ১২ ০১ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়। কারণ এ সময় তুর্কি মুসলমান শাসক বাংলা দখল করে নেয় ফলে বাংলা সাহিত্যের চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে এই সময়ের মধ্যেও দু একটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন \” শ্রীকৃষ্ণকীর্তন\”। সহজিয়াগণ এটা রচনা করেছেন বলে অনেকে ধারণা করেন। বাউল গানের সাথে এই সহজিয়াগণের একটা সম্পর্ক আছে। মূলত এই সহজিয়াগণের হাত ধরেই বাউল গানের উৎপত্তি। বড়ু চণ্ডিদাসের লেখায় প্রথম বাউল শব্দটি লক্ষ্য করা যায়। বড়ু চণ্ডিদাসও সহজিয়াগণের মধ্যে একজন। এ ছাড়াও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম গ্রন্থে বাউল সঙ্গীত ধর্মীয় সঙ্গীত, মধ্যযুগে প্রথম পাদে বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাস, জ্ঞানদাস ও বলরামদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাতিক প্রেমচেতনার একটি পার্থক্য দর্শিয়েছেন। আবার মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্ত পদাবলিগণ তাদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরুপে বন্দনার কথা বলেছেন। আর এজন্যই পরবর্তীতে বাউল গানে মানব প্রেম ও ঈশ্বর প্রেমের আকুল আবেদন স্থান পেয়েছে। পনের শতকের শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলেখা, মালাধর বসুর \” শ্রীকৃষ্ণ বিজয়\”, ষোল শতকের বাহরাম খানের লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের \”চৈতণ্যচরিতামৃত\” গ্রন্থে বাউল শব্দের ব্যবহার আছে।

তবে কোন কোন ইতিহাস বিদের মতে শতের শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার \’বাংলার বাউল ও বাউল গান\’ গ্রন্থে লিখেছেন বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ সালের দিকে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে \” বৌদ্ধদের মহাযান পন্থি থেকে বাউলের উৎপত্তি\”।

বাউল গানের পথিকৃৎ হিসেবে সিরাজ সাঁই, লালন শাহ্কেই ধরা হয়। এছাড়াও যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে পাঞ্চু শাহ্, দুদ্দু শাহ্ প্রধান। তবে অাধুনিক যুগে শাহ্ আব্দুল করিম অন্যতম। তবে বাউল গানকে মানুষের কাছে যিনি পৌঁছে দিয়েছেন তিনি হলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লালন শাহের ২০০ টিরও অধিক গান সংরক্ষণ করেছিলেন। বাউল গান বাংলার সম্পদ। ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আজ বাউল শিল্পীরা অযত্নে অবহেলায় দিন কাটায়। অথচ বাঙালি সংস্কৃতির কত বড় গুরুভার তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বহন করে চলেছে। সমৃদ্ধি করছে আমাদের সংস্কৃতিকে। আধুনিক যুগে বাউল গান ছাড়া কনসার্টই জমে না। মানুষের হৃদয়ের সবটুকু জায়গাই দখল করে রয়েছে এই বাউল গান, জীবনের গান, প্রেমের গান,বিরহের গান, মানবতার গান।

দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১২ ঘণ্টা, ০৭ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ

 

Scroll to Top