৯২’র ভুল নীতি: রোহিঙ্গারা যাবে না

গোলাম মোর্তোজা
সরকারের একটি ‘কাজ বা নীতি’ নিয়ে প্রশ্ন তুললে-সমালোচনা করলে, সেটাকে ‘সরকার বিরোধী’ বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘দেশ বিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনদের ভেতরে এই প্রবণতা শুধু বাড়ছেই। আত্মসমালোচনা তো নেই-ই, ভুল ধরিয়ে দিলে বা কোনও প্রস্তাব দিলে, সেটা মানা বা না মানা পরের কথা, মূল্যায়ন করার প্রয়োজনই মনে করা হয় না। প্রশ্নহীন, শর্তহীন অন্ধ আনুগত্যের প্রত্যাশা করা হয়। আনুগত্য দেখালে পুরস্কার, না দেখালে তিরস্কার। পুরস্কারের প্রতি আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে দৃশ্যমান অসঙ্গতিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানুষের সংখ্যা কমছে। যারা প্রশ্ন তুললে সরকার বিষয়গুলো হয়ত দ্বিতীয়বার ভাবত, তাদের অনেকে চুপ- অধিকাংশই পুরস্কার প্রত্যাশী। বলছি বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের কথা। বিশেষ করে সরকারকে যারা সমর্থন করেন সেই সব বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজ যদি প্রশ্ন তুলে পর্যালোচনা করে সরকারকে দিক নির্দেশনা দিতেন, তবে ভুল শোধরানোর সুযোগ তৈরি হতো। যা বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অল্প কয়েকজন কাজটি করছেন বা করার চেষ্টা করছেন, নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। ব্যক্তিগত আক্রমণের মূখে পড়ে কেউ কেউ আবার চুপ থাকার নীতি গ্রহণ করছেন।
এই সুযোগে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। ভুল নীতি থেকে সরে আসার চেষ্টা হচ্ছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এমন কিছু প্রসঙ্গ।

১. গণতান্ত্রিক আবরণ থাকলেও মিয়ানমারের সরকার পরিচালনা করে সামরিক বাহিনী। সংসদে সামরিক বাহিনীর ২৫% আসন সংরক্ষিত। অং সান সু চি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সু চি’র ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। যা মেনে নিয়ে সু চি ক্ষমতা, সুযোগ- সুবিধা উপভোগ করছেন। সেই সু চি’র দফতরের একজন মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ে। তার ক্ষমতা যে কত কম, বলার অপেক্ষা রাখে না। তার নেতৃত্বে ৫ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-আমলারা তার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত হলো। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির একটি খসড়া হস্তান্তর করলো বাংলাদেশ। সেই আলোচনায় পরে আসছি।

প্রথমেই প্রশ্ন আসে, সু চি’র দফতরের এই গুরুত্বহীন মন্ত্রীকে এতটা গুরুত্ব কেন দিল বাংলাদেশ? বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে ভুক্তভোগী বলে? এটা জোরালো যুক্তি হতে পারে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপে আছে মিয়ানমার। চাপে আছেন সু চি। বাংলাদেশ বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাপে থাকার কথা নয়। প্রটোকল অনুযায়ী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব আলোচনা করলে, সেটাই হতো সঠিক। মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি। তিনি আসলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্য সচিব আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন। মিয়ানমারের একজন গুরুত্বহীন মন্ত্রীকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার আদৌ কোনও দরকার ছিল বলে মনে হয় না।

২. এবার আসি আলোচনা প্রসঙ্গে। বহু বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা যায়নি। এত বছরেও রোহিঙ্গা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে না পারা, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। সেই দুর্বলতা এবার বেশ ভালোভাবে কেটেছে। মিয়ানমারের ঘটানো গণহত্যা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃঢ় এবং কার্যকর ভূমিকার কারণে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়েছে। নিশ্চয়ই সরকারের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না, করছিও না। বরং এই আলোচনায় কৃতিত্ব দিতে চাই যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে সরকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে সুনির্দিষ্ট পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপে পড়ে মিয়ানমার আলোচনায় আগ্রহী হয়েছে। পরিস্থিতি সঠিক পথেই চলছিল।

প্রশ্ন হলো, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা যে মিয়ানমারের একটা কৌশল বাংলাদেশ তা বুঝতে পারল না কেন? প্রশ্ন আসবে, আর কী করার ছিল, মিয়ানমারের আলোচনার প্রস্তাব বাংলাদেশের ফিরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল? না, তা করলে বাংলাদেশের ইমেজের ক্ষতি ছাড়া লাভ হতো না। বাংলাদেশের কৌশলগত কারণে এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসা দরকার ছিল। প্রাথমিকভাবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে বাংলাদেশ বলতে পারত, বাংলাদেশে অবস্থানরত দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে। তখন মিয়ানমার ‘যাচাই-বাছাই’র প্রসঙ্গ সামনে আনত। বাংলাদেশের অবশ্যই দৃঢ়তার সঙ্গে ‘যাচাই- বাছাই’ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করা দরকার ছিল। যদি পরিস্থিতির কারণে বিরোধিতায় ফল না আসত, তবে অবশ্যই বলা দরকার ছিল ‘যাচাই-বাছাই’ হবে জাতিসংঘের উপস্থিতিতে। এই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে হয়তো মিয়ানমার আলোচনা ছেড়ে চলে যেত। তাতে বাংলাদেশের কোনও ক্ষতি ছিল না। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ত। বাস্তবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিয়ানমার যা চাইল, যেভাবে চাইল, প্রায় সবকিছু সেভাবে ঘটল।

ক. মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৭৮ সালের চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ‘যাচাই-বাছাই’র প্রসঙ্গ ছিল না। ‘যাচাই-বাছাই’ প্রসঙ্গ ছিল ১৯৯২ সালের চুক্তিতে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়।খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এই চুক্তির পেছনে ভূমিকা ছিল তখনকার অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ চৌধুরীর। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নেবে, যদি তারা মিয়ানমারের নাগরিক হয় তা ‘যাচাই- বাছাই’ করে। ‘যাচাই- বাছাই’ করবে মিয়ানমার।১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়ার বিষয়টি জানা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এই চুক্তি করেছিল। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল প্রত্যবাসন হবে ‘স্বেচ্ছামূলক’ অর্থাৎ ‘যদি কেউ যেতে না চায়, জোর করে’ পাঠানো যাবে না।

বাংলাদেশের স্বার্থ পরিপন্থী দ্বিপাক্ষিক এই চুক্তির জন্যে তখনকার অতিরিক্ত সচিব আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরীকে কিছুটা দায়ী হয়ত করা যায়। কিন্তু পুরো দায় তো বিএনপি সরকারের। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই তো চুক্তি হয়েছিল। বর্তমান সরকার ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করার মিয়ানমারের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। বিএনপি এটাকে বলছে ‘ভাওতাবাজি’। বিএনপিকে তো এখন স্বীকার করতে হবে যে, প্রথম ‘ভাওতাবাজি’টা তারাই করেছিল।

এবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাসনে সু চি ১৯৯২ সালের চুক্তির প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিল। সু চি’র মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ সেই ‘যাচাই-বাছাই’র প্রক্রিয়াতে যেতে সম্মতি দিয়েছে। মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিবৃতি দিয়ে এই চুক্তি অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে।

খ. মিয়ানমার ১৯৮২ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। ভোটাধিকারসহ বঞ্চিত করে রেখেছে সকল রকম রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে। তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, এমন কোনও বৈধ কাগজপত্র রোহিঙ্গাদের কাছে নেই। তাহলে কি ‘যাচাই-বাছাই’ করে প্রমাণ হবে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক? এই ‘যাচাই-বাছাই’ করবে মিয়ানমার। জাতিসংঘকে এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে রাখা হবে না। যদিও ১৯৯২ সালের চুক্তিতে ইউএনএইচসিআর’র ভূমিকা রাখার একটা সুযোগ রাখা হয়েছিল। এবার এই সুযোগ মিয়ানমার রাখতে চায়নি, বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকতে চায়। থাকলেও লাভ হবে না। কারণ বাংলাদেশের কাছে কাগজপত্রের কোনও প্রমাণ নেই যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। জাতিসংঘ – ইউএনএইচসিআর জানে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। কাগজপত্র না থাকলেও জাতিসংঘ বললে, তা খুব সহজে উড়িয়ে দিতে পারত না মিয়ানমার। উড়িয়ে দিলেও আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশের পক্ষে থাকত।

আলোচনায় রেডক্রসের প্রসঙ্গ এসেছে। মিয়ানমার হয়তো শেষ পর্যন্ত ‘যাচাই-বাছাই’ প্রক্রিয়ায় রেডক্রসকে সম্পৃক্ত করতে পারে, তাতে সম্মতি দিতে পারে বাংলাদেশ। ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, নাগরিকত্ব ‘যাচাই-বাছাই’র ক্ষেত্রে রেডক্রস কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখতে পারবে না। এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। জাতিসংঘ বা ইউএনএইচসিআর’র এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ ও এখতিয়ার আছে।

গ. ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার মিয়ানমারের এই নীতির সঙ্গে একমত পোষণ করে, বাংলাদেশ সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়ে শেষ সুযোগটি হাতছাড়া করে ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পথ প্রায় চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। যদি ১৯৯২ সালের চুক্তি পরিমার্জন করতে পারে বাংলাদেশ, একটা সম্ভাবনা টিকে থাকবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ধরনে বিশ্বাস রাখা কঠিন যে, বাংলাদেশের দেওয়া খসড়া প্রস্তাবে পরিমার্জনের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত থাকবে।

১০ লক্ষাধিক বা এবার আসা ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার তালিকা দেবে বাংলাদেশ। মিয়ানমার সেই তালিকা মিলিয়ে নাগরিকত্ব কার্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র যাদের কাছে আছে, যা দিয়ে প্রমাণ হবে যে তারা মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের ফিরিয়ে নেবে যদি তারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়। তাদের নিজ বাড়িতে, মূল জমিতে পুনর্বাসন করা হবে। শর্তগুলো একবার ভেবে দেখেন আর রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতিটা চিন্তা করেন। এটা সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার বিষয় নয়, বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চিন্তা করেন।

অতীতে কখনও মিয়ানমার এমন গণহত্যা চালায়নি, রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি এভাবে জ্বালায়নি। এবার বাংলাদেশে আসা এমন কোনও রোহিঙ্গা পরিবার নেই, যাদের পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী হত্যা করেনি, ধর্ষণ করেনি। কারও ঘরবাড়ির অস্তিত্ব নেই, সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তে মাইন পুতে রেখেছে সামরিক বাহিনী। ‘যাচাই- বাছাই’ প্রক্রিয়ায় প্রমাণ হবে ৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিক। নাগরিকত্ব বাতিল করার পর এক ধরনের কার্ড দেওয়া হয়েছিল হাজার পাঁচেক রোহিঙ্গার। এর বাইরে কোনও রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই। এই হাজার পাঁচেক মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলবে, আমাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছি। বিশ্ব সম্প্রদায় আর এখনকার মতো চাপ দিতে পারবে না। যদি চাপ দেয়ও, তেমন কিছু হবে না তারপরও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, মিয়ানমার সীমান্ত খুলে দিল- রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাল। একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে রাজি হবে, ওই মৃত্যুপুরীতে? কেউ যেতে রাজি হবে না। ‘জোর করে’ পাঠাতে পারবেন না। এমন একটা পরিস্থিতি মিয়ানমার বহু বছরে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করেছে। তাহলে বাংলাদেশ কোন চাপে, কাদের বুদ্ধিতে ১৯৯২ সালের ফর্মুলার সমাধানে সম্মত হলো?

সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও, হঠাৎ করে সরকার কেন বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী নীতি মেনে নিল?

৩. আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে একটা ধাক্কা সামলানোর সুযোগ পেয়ে গেলো। ঢাকায় যেদিন ( ২ অক্টোবর ) সু চি’র মন্ত্রী আলোচনা করলেন, সেদিনই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখাইনের কিছু অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার। পূর্বে যাদের যেতে দিতে রাজি হয়নি। তারা মানবিক বিপর্যয় নিজেদের চোখে দেখেছেন, সরকারের ব্যবস্থাপনায় গিয়েও। মিয়ানমার সরকার এসব কিছুর জন্যে দায়ি করেছে ‘আরসা’কে। পুরোটা না হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছুটা তা বিশ্বাসও করেছে। ফিরে এসে তারা মানবিক বিপর্যয়ের কথা যেমন বলেছেন, ‘আরসা’র সন্ত্রাস বিষয়েও বলেছেন। আরও বলেছেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা এখন সন্তোষজনক।

বাস্তবে মিয়ানমার এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে, এদিনও (২ অক্টোবর) ৩০ থেকে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। প্রতিদিন ঢুকছে।

মিয়ানমার আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখালো যে, তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে’। মিয়ানমার যা বলতে চায়, তা বললেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব তা জানল। আন্তর্জাতিক বিশ্ব জানল না যে, আজও (২ অক্টোবর) ৪০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে, হত্যা, বাড়ি-ঘর জ্বালানো অব্যাহত রাখা হয়েছে। জাতিসংঘসহ কেউ জানল না যে, মিয়ানমার সীমান্তে আন্তর্জাতিক আইন অনবরত লঙ্ঘন করছে, সৈন্য সমাগম করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব কথা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়নি।

মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘পাঁচ দফা’ আনা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা পাঁচ দফার বিষয় নয়’। কেন পাঁচ দফার বিষয় নয়? প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘সেভ জোন’ ‘স্থায়ী সমাধান’ আলোচনার বিষয় নয়?

প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন জাতিসংঘে। আর বাংলাদেশ এখন সমাধান ফর্মুলা খুঁজছেন জাতিসংঘকে বাদ দিয়ে। তো সেই প্রস্তাব যদি মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা না করেন, তাহলে দেওয়া হলো কেন?

৪. সরকার খুব দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবেন, এটা কেউই মনে করেন না। সরকার ব্যর্থ, এভাবে দায়ও চাপাতে চাই না। কারণ পরিস্থিতিটাই অত্যন্ত জটিল। জনমানুষের প্রত্যাশা দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে সরকার চেষ্টা করবে। সরকার যতটা পারছে যতটা পারছে না- সঠিক চিত্র মানুষকে জানাবে। যদিও ১৯৯২ সালে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশ স্থায়ী সংকটে ইতিমধ্যে পড়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পথ। জাতিসংঘকে বাদ দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসার চাপ দিয়েছে চীন, ভারত। সেই চাপ মোকাবিলা করে অটল থাকতে পারেনি বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চিন্তার চেয়ে, স্থায়ী জায়গা খোঁজার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করছে সরকার। এখন এসব কিছু আড়াল করার চেষ্টা চলছে।

বাস্তবে ঘটনাক্রম এক রকম, সরকার বলার সময় বলছে আরেক রকম। সরকার সংশ্লিষ্টরা তা আরও জোর দিয়ে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘মিয়ানমার আগের চেয়ে নমনীয় হয়েছে’। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে মিয়ানমার তার নীতি বাস্তবায়নের কৌশলে এগিয়ে গেছে। আলোচনা করতে এসেছে, আপনার নীতি তার ওপরে চাপাতে পারেননি। তার নীতি অনুযায়ী আপনি রাজি হয়েছেন। এখানে নমনীয়তার কোনও বিষয় নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, ‘রেকর্ড আছে যাদের (রোহিঙ্গা), তাদের ফিরিয়ে নেবে’।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না। মিয়ানমারের কাছে ‘রেকর্ড আছে’ দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজারের। তার মানে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন হাজার পাঁচেক। অন্যদের ‘যাচাই-বাছাই’র নামে সময় ক্ষেপণ করবে, ফিরিয়ে নেবে না। আর আপনি বলছেন ‘নমনীয়’ হয়েছে। কেন বলছেন, বুঝে নাকি না বুঝে?

সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা প্রতিদিন বলছেন ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। মিয়ানমারে ভারতের যে আর্থিক-সামরিক স্বার্থ, সেখানে অবস্থান পরিবর্তনের কোনও সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ভারতের সামনে তার অপরিহার্যতা এমন ভাবে তুলে ধরেনি বা ধরতে পারেনি যে, ভারত অবস্থান পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করবে।

‘ত্রাণ’ দেওয়া আর অবস্থান পরিবর্তন যে এক নয়, তা বোঝার জন্যে বেশি বুদ্ধি থাকার দরকার হয় না। ভারত মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে চুপ আছে। যদি বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া বিষয়ক কোনও কথা মিয়ানমারকে বলত, তাহলে বলার সুযোগ ছিল অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন না করে সু চি’কে ফোন করলে বোঝা যেত অবস্থান পরিবর্তন করেছে।

এ কথাও বলছেন, চীন-রাশিয়াও অবস্থান পরিবর্তন করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ অবস্থানের পরও যদি কেউ বলেন যে, তারা অবস্থান পরিবর্তন করেছে, আর যাই হোক তা সত্যি নয়। বলা যেতে পারত, ভারত-চীন-রাশিয়ার অবস্থান পরিবর্তন করানোর জন্যে সরকার চেষ্টা করছে। সফল না হলে, সত্যটাই মানুষকে জানানো উচিত।

দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সুবিধা নেওয়া কঠিন নয়। দর কষাকষির আলোচনায় যোগ্যতা- সক্ষমতা প্রমাণ করাটা সহজ নয়। সহজ যে নয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ তা আরও একবার প্রমাণ করলো।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, ০৫ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ

Scroll to Top