ইকরাম কবীর
সমাজে একটি ধারণা আছে যে গণমাধ্যম কর্মীরা সৎ মানুষ হবে এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবন-যাপন করে খুশি থাকবে। তাদেরকে কয়েক মাস বেতন না দিলেও তারা কাজকর্ম মনোযোগ দিয়ে করে যাবে। তাদের ছেলেমেয়েরাও তাদের মতই একদিন মধ্যবিত্ত হবে। একদিন এই কর্মীরা বৃদ্ধ হবে, নানা রকমের অসুখ-বিসুখ এসে ভর করবে এদের শরীরে, চিকিৎসা ব্যয় না থাকায় অন্যের বা সরকারের দ্বারস্থ হবে, কেউ-কেউ অথবা মাঝে-মধ্যে সরকার তাদের সাহায্য করবেন, তারপর অর্থের সংকুলান না হওয়ায় মারা যাবে।। তারপর পত্রিকায় তাদের নিয়ে সুন্দর-সুন্দর কথা ছাপা হবে, নেতা-নেতৃরা বাণী দেবেন। ব্যাস, সংবাদকর্মীদের জীবন এখানেই সমাপ্ত!
শুনছি অনেক বাড়িওয়ালা সংবাদকর্মী হলে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। দু’কারণে। এক: হয়তো বাড়ি ভাড়া সময় মতো দিতে পারবে না, এবং দুই: তারা ‘সাংঘাতিক’ এবং তাদের জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা নেই। আমি যখন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম, তখন দেখেছি সমাজ সাংবাদিকদের টাইপিস্ট ভাবতো। ‘ওহ, তুমি সাংবাদিকতা করো, চাকরি করো না!’ – এমনই ছিল সমাজের ধারণা। এই ধারণার এখন একটি নতুন চিন্তা এসে হাজির হয়েছে – ‘আরে! সাংবাদিকতা দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ, সবাই পারে; কেউ চাকরি-বাকরি না পেলে সাংবাদিক হতে আসে’।
জানতে পারলাম সদ্য বাজারে আসা একটি টিভি চ্যানেলে কয়েক মাস ধরে কর্মীরা কেউ বেতন পান না। তিন মাস বেতন না পেয়ে তারা বিক্ষোভ করেছেন এবং অফিসে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, একজন ক্যামেরা-পারসন অর্থের অভাবে তার শিশুর চিকিৎসা না করাতে পারায় শিশুটি মারা গেছে। আরেকজন বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় অফিসেই স্ট্রোক করে এখন হাসপাতালে। বাড়িওয়ালা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।
আমাদের এই রিউমার-মঙ্গারিং সমাজের ধারণা সংবাদ কর্মীরা নাকি অনেকে বেতন চান না; তাদের নাকি একটি আইডি কার্ড ধরিয়ে দিলেই তারা খুশি, কারণ সমাজ মনে করে, সেই আইডি কার্ড দিয়েই তারা করে খাবে। এরা মনে করে দেশে চাহিদার চেয়ে সংবাদকর্মীর সংখ্যা নাকি বেশি। এমন শিক্ষিত সমাজ যদি এমন ভুল ধারণা নিয়ে বসবাস করতে থাকে, তাহলে খুবই কষ্টের কথা।
আসলে দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে যে কর্মী পাওয়া যায় না এ বিষয়টি তাদের কে বোঝাবে! দেশে কোন পেশা আছে যেখানে বেতন লাগে না? আর একজন ক্যামেরা-পারসনকে কত বেতন দেওয়া হয় কারো ধারণা আছে? একজন জুনিয়ার রিপোর্টার মাস গেলে কত পায় তা কেউ ভাবতে পারেন? খুব বেশি হলে ১২ হাজার টাকা পান তারা। তাদের নেই কোনও প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা, নেই কোনও বাড়ি ভাড়ার সুবিধা, নেই কোনও স্বাস্থ্য ভাতা। একটি চ্যানেলের কথা জানি যেখানে দু’মাস পর-পর বেতন দেওয়া হতো।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, জ্বর-জারি উপেক্ষা করে যে ছুটে বেড়ান – সে সম্পর্কেও সমাজের কোনও ধারণা আছে বলে আমার মনে হয় না। সমাজ মনে করে এরা সবাই ‘চাঁদাবাজী’ করে বেড়ায়!
এমন অনেক চ্যানেল আছে যারা অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার জন্য কোনও বাহনও দেন না, এমন অনেক। অনেক চ্যানেলে ঠিকমত বাথরুমেরও সুবিধা নেই, অনেক চ্যানেলে একটি খাওয়ার ক্যান্টিন নেই, অনেক চ্যানেল এমন স্থানে অফিস নিয়েছে যে রাতে বাড়ি ফেরার সময় হাইজ্যাকাররা টাকা-পয়সা যা আছে তা ছিনিয়ে নেয়।
যারা এতগুলো টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সের অনুমতি দিচ্ছেন তারা এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। কোনও এক ব্যবসায়ীর শখ হলো যে তিনি একটি চ্যানেলের মালিক হবেন, তার সঙ্গে রাজনৈতিক মতের মিল থাকলেই পেয়ে যাচ্ছেন লাইসেন্স। এরপর কী করে চ্যানেলটি চলবে বা টিকে থাকবে সে বিষয়ে কোনও চিন্তা নেই। ব্যবসায়িক সফলতা আসবে কী আসবে না, সে চিন্তা না করেই, এ বিষয়ে কোনও সমীক্ষা না চালিয়েই খুলে ফেললাম একটি দোকান। আমি একজন লাইসেন্সধারীকে চিনি যিনি লাইসেন্স পাওয়ার পরই লাইসেন্সের ক্রেতা খুঁজতে শুরু করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা সংবাদ সংস্থার মালিক হলে অনেক লাভ। তাদের নিজেদের কথা বাজারে আরও বেশি-বেশি বলতে পারবেন। তাতে অসুবিধে নেই; তিনি বিনিয়োগ করেছেন, তিনি বলতেই পারেন।
এতগুলো দৈনিক পত্রিকার অনুমতি কেন দেওয়া হয়? এত-এত পত্রিকা থাকা মানেই কি দেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন? এটিই প্রমাণ করার জন্য? ক’টি পত্রিকা প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে? ক’টি পত্রিকা ঠিকমত তাদের কর্মীদের বেতন দিচ্ছে? সারাদেশে প্রায় ছ’শর বেশি দৈনিক পত্রিকা ছড়িয়ে আছে।
মফস্বল শহরের সংবাদকর্মীদের আরও করুণ অবস্থা। তাদের সংবাদ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পাশাপাশি অন্য চাকরি করতে হয়, কোনও না কোনও ব্যবসা করতে হয়, নাহলে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। হ্যাঁ, অসৎ সংবাদকর্মী যে নেই তা বলছি না। তবে ক’জন নিজের তাগিদে অসৎ হচ্ছেন আর ক’জন প্রতিষ্ঠানের মালিকের চাপে অসৎ হচ্ছেন তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ওয়েজ-বোর্ড নামে সংবাদকর্মীদের জন্য একটি সরকারি নিয়ম চালু আছে। ওয়েজ-বোর্ড তৈরিই হয়েছে যেন সংবাদকর্মীরা তাদের কাজের ন্যূনতম মজুরি পান। কতগুলো সংবাদপত্র ওয়েজ-বোর্ড মেনে চলছে। টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন ও অনলাইন পত্রিকায় ওয়েজ-বোর্ড নেই কেন?
হাজার হাজার অনলাইন পত্রিকায় যারা কাজ করেন তাদের কথা আজ নাইবা বললাম।
দেশে কতগুলো রেডিও স্টেশন আছে তা কেউ ভেবে দেখেছেন? সেখানে সবাই ঠিক মতো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন কিনা কে খবর রাখছে? একজন আরজে (বা রেডিওজকি) কত ভাতা পান, একজন সাউন্ড-ইঞ্জিনিয়ার কত বেতন পান? তাতে কি তার সংসার চলে? একজন সাউন্ড-ইঞ্জিনিয়ার দেশে তৈরিই হয় বা কী করে? দেশে সাউন্ড-ইঞ্জিনিয়ারিং শেখার জন্য কি কোনও প্রতিষ্ঠান আছে? এরা যদি নিজের তাগিদে সাউন্ড-ইঞ্জিনিয়ারিং না শিখতো তাহলে এই রেডিও স্টেশনগুলো এ ধরনের মানব-সম্পদ কোথায় পেতেন?
প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি করে ব্যবসায়িক মডেল থাকে। সংবাদমাধ্যম পুরোপুরিই অন্য ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। এখন দেশের ব্যবসা খাতের হাতে কি এতোই অর্থ যে যত খুশি সংবাদ প্রতিষ্ঠান আসুক না কেন তারাই এগুলোকে বিজ্ঞাপন দিয়ে টিকিয়ে রাখবে? না, আদতে তা হয় না।
দেশের সংবাদ মাধ্যমের নেতারা সংবাদকর্মীদের ভালো-মন্দ দেখার ব্যাপারে কী করছেন তা ঠিক বোঝা যায় না। তারা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে, তখন এই পেশার কর্মীদের স্বার্থ নিয়ে ভাবাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে বলেই আমাদের মনে হয়। তবে খুব কি কঠিন হয়? দেখুন না, পুলিশের নেতারা পুলিশের স্বার্থ দেখছেন, সরকারি কর্মচারি নেতারা তাদের স্বার্থ দেখছেন, ডাক্তারদের নেতারা ডাক্তারদের স্বার্থ দেখছেন! তো সাংবাদিক নেতারা সংবাদকর্মীদের স্বার্থ দেখবেন এটিই সবার আশা।
লেখক: গল্পকার ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, ০২ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ