ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পিতা একদিন বাড়ি এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ‘হাচুমনি’ ডেকে কপালে চুম্বন এঁকে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের নয়নমণি ছোট্ট ‘হাচুমনি’ একদিন বড় হয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা হয়ে উঠলেন; ধীরে ধীরে বিশ্বনেত্রীর মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
অসাম্প্রদায়িক, উদার, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানমনস্ক জীবনদৃষ্টি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে পরিণত করেছে এক আধুনিক ও অগ্রসর রাষ্ট্রনায়কে। একুশ শতকের অভিযাত্রায় তিনি দিন বদল ও জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাণ্ডারী।
পঁচাত্তরে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষই ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনার। বাংলার মানুষের জন্যই জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগানোর পণ তাঁর। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই দেশ আজ দারিদ্র্যের খাঁচা থেকে বের হয়ে সমৃদ্ধির পথে সাবলীল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে তিনি মঙ্গা দূর করেছেন। দক্ষ হাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তিনি দেশের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন। যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে তিনি জাতিকে করেছেন কলঙ্কমুক্ত। কিন্তু প্রিয় নেত্রীর সুদীর্ঘ এই পথচলা মোটেই মসৃণ ছিল না, ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে।
আজ ঐতিহাসিক ১৭ মে। ১৯৮১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে দেশে ফিরে আসেন বাংলার দুঃখী মানুষের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল ও বাঙালির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা।
বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রিয় নেত্রীকে সেদিন একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে লাখো মানুষের ঢল নামে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল না। দেশে ফিরে প্রিয় নেত্রী বিপর্যস্ত, ভঙ্গুর ও অগোছালো আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছুটে যান জনমানুষের কাছে। বলেন, ‘আমার একমাত্র দায়িত্ব পিতার অধরা স্বপ্ন সফল করা।’
১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আরোহণকে অবৈধ ঘোষণা করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৩ সালে তিনি পনেরো দলের একটি জোট গঠন করেন। দেশজুড়ে সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠায় ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাসহ ৩১ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী সমাবেশের ভাষণে ’৭৫ পরবর্তী সব সরকারকে অবৈধ আখ্যা দেন শেখ হাসিনা। ১৯৮৪ সালে তিনি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের ষষ্ঠ কংগ্রেসে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের আমন্ত্রণে তিউনিশিয়ায় ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এর সদর দফতর সফর করেন এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি হজব্রত পালন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ হাসিনা পুনরায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৮৭ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশন ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স নামে সংগঠনের আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্যান্সিসকোয় অনুষ্ঠিত নারী নেত্রীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। ১৯৮৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের সপ্তম কংগ্রেসে তিনি পাঠ করেন ‘নিরস্ত্রীকরণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ। একই বছর যোগদান করেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রাগে অনুষ্ঠিত প্রেসিডিয়াম বৈঠকে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হওয়া ৮ দলের মিছিলে জনতার ওপর পুলিশ ও বিডিয়ার নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় ৯ জন নিহত হয়। শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে ১৯৯০ সালে তিনি এক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর আন্দোলনের জোয়ার ঠেকাতে সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং শেখ হাসিনাকে ধানমণ্ডির বাসায় গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়। ৪ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯০ সালে অভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৮১ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরামহীন সংগ্রাম এবং গতিশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তিপায় বাংলাদেশ।
১৯৯১ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সংসদীয় সভায় সর্বসম্মতভাবে সংসদীয় দলের নেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালের ২১ মার্চ সরকারিভাবে শেখ হাসিনাকে বিরোধীদলের নেত্রী ঘোষণা করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর সংসদ উপ-নির্বাচনের সময় সন্ত্রাসীরা তাঁকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। ১৯৯২ সালের ৭ মার্চ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০০ জন সংসদ সদস্য শহীদ জননী জাহানার ইমামের গোলাম আযমকে গণআদালতে বিচারের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ১৬ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল করে গোলাম আযমের বিচার করার প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সভায় গুলি ও বোমা হামলায় ৫০ জন আহত হয়। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনা স্বাধীনতার সূতিকাগার জাতির পিতার ধানমণ্ডিস্থ ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবনটি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে’ রূপান্তর করে তা দেশবাসীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার ট্রেন অভিযাত্রায় ঈশ্বরদী ও নাটোরে ব্যাপক সন্ত্রাস, গুলি, বোমা হামলা ও তাঁকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। এ ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশসহ আহত হয় শতাধিক।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এ পাঁচ বছর ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সময়। এ সময়কালের মধ্যে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা সেতু নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পিতার সঙ্গে মাতার নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা, প্রথম মুঠোফোন প্রযুক্তির বাজার উন্মুক্ত করে দেয়া, কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসকরণের দ্বারা সাধারণের হাতে হাতে বিশ্বায়নের মাধ্যম পৌঁছে দেয়া, দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশরত্ম শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে চলে যায় দেশ। গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। ২০০৪ সালে ২১ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তাঁকে এবং তাঁর অনুগামীদের হত্যার উদ্দেশ্যে নরকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবাণীতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরাতে ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই প্রিয় নেত্রীকে গ্রেফতার করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কারান্তরীণ থাকেন।
নবম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে শেখ হাসিনা জাতির সামনে ‘দিনবদলের সনদ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। প্রতিশ্রুত এই সনদ তখন জনমনে নাড়া দিয়েছিল। বিশেষ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার লুফে নেয় তরুণ প্রজন্ম। ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৪ আসন লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অসীম সাহস, দৃঢ মনোবল ও অভীষ্ট লক্ষ্যে অবিচল থেকে সব চ্যালেঞ্জ এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জননেত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৫ হাজার ৪৭৯ মার্কিন ডলারের বেশি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে গণতন্ত্রের মানসকন্যা, বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ম শেখ হাসিনার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। জয়তু জননেত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: সাবেক সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়