চোখের সামনে সেনা সদস্যরা নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে। একজন দু’জন নয়। তিন সেনা সদস্য পালাক্রমে ধর্ষণ করছে হাসিনা বেগম (৪৫)কে। পাশে বসে সেই দৃশ্য সহ্য করতে হয়েছে স্বামী সুলতান মাহমুদ (৬২)কে।
সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে বুক ফেটে যায় তার। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে অশ্রু। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না তিনি।
সুলতান মাহমুদ আর হাসিনা বেগম রোহিঙ্গা দম্পতি। আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের বালুখালিতে শরণার্থী শিবিরে। সেখানে বসেই নিজেদের জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায় খুলে বলেছেন তারা বার্তা সংস্থা এপি’র কাছে। খবর মানবজমিনের।
২৫ শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর তাদের ৯ সন্তান পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। কিন্তু ভিটে, মাটির ঘ্রাণ ছাড়তে পারছিলেন না সুলতান মাহমুদ আর তার স্ত্রী হাসিনা বেগম। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেকে যান রাখাইনের বাড়িতেই। গ্রামে তাদের মুদি দোকান আছে। জমি আছে। তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায় সংসার। এসবের মায়া ছাড়তে পারেন নি তারা।
এ ছাড়া পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার ক্ষেত্রে তাদের সামনে আরো একটি বাধা ছিল। তা হলো সুলতান মাহমুদের একটি পা নেই। দু’বছর আগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে গুলি করেছিল। সেই গুলি লাগে তার ডান পায়ে, হাঁটুর নিচে। সেখান থেকে কেটে ফেলতে হয় পা। এ জন্য অন্যদের মতো পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা তার জন্য সহজ ছিল না। তাই এই দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের বাড়িতেই থেকে যাবেন।
কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। আবার হামলা হয় তাদের গ্রামে। সুলতান মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমাকে নির্দয়ভাবে পেটায় সেনারা। আর আমার স্ত্রীকে তিন সেনা সদস্য পর্যায়ক্রমে ধষর্ণ করতে থাকে। বলতে বলতে তার মাথা নিচু হয়ে যায়। চোখ থেকে ঝরে পড়ে অশ্রু। লম্বা করে দম টানেন সুলতান মাহমুদ। পাশেই বসা তার স্ত্রী হাসিনা বেগম। তিনি লজ্জায় মুখ ঢাকেন। ছল ছল করে ওঠে চোখ।
হাসিনা বেগম হু হু করে কেঁদে ওঠেন। সুলতান মাহমুদ বলতে থাকেন- ওই সেনা সদস্যরা আমার স্ত্রীর সঙ্গে খুবই খারাপ কাজ করেছে। তারা তার সঙ্গে খুব বাজে কাজ করেছে।
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরে তাদের এক ছেলে মিয়ানমারে ফিরে যান। উদ্দেশ্য, পিতামাতাকে সীমান্ত অতিক্রম করে বালুখালি নিয়ে যাওয়া। এই বালুখালিতে শরণার্থীদের বেশির ভাগই ঠাঁই পেয়েছেন। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার এমনই শিকার হয়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা এবার আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে।
আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। ২৫ শে আগস্ট রাখাইনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৩০টি পোস্ট ও ক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)। তার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর শুরু করে এক অবর্ণনীয় নৃশংসতা। ওই এলাকায় সাংবাদিক বা নিরপেক্ষ কোনো পর্যবেক্ষকের প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও যেসব তথ্য বাইরের দুনিয়া এখন জানতে পেরেছে তাতে গা শিউরে ওঠে।
সেনাবাহিনীর এমন নৃশংসতায় রোহিঙ্গারা বাণের পানির মতো পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকেন। তাদের ওপর এমন নির্যাতনকে জাতিসংঘ জাতি নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অনেকটা পরে হলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সরকার এসব নৃশংসতার দায় চাপানোর চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের ওপরই।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে এরই মধ্যে যেসব তথ্যপ্রমাণ পৌঁছে গেছে তা থেকে সুচি সরকারের উত্তরণ খুব কঠিন। এ সঙ্কট নিয়ে আজ তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত বিতর্ক হবে। এরপর করণীয় নির্ধারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ সময় : ১২৫৮ ঘণ্টা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/ডিএ