কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার শঙ্কায় যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না পুলিশ

ব্যাংক আলফালাহ্ লিমিটেডের চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল মোরশেদ চৌধুরীকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার মামলায় বিগত ১১ দিনেও কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি। বাদীপক্ষের আশঙ্কা, গ্রেফতার না হওয়ার কারণে আসামিরা এ মামলার তদন্ত প্রভাবিত করতে পারে।

এ ধরনের অপচেষ্টা তারা অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ থেকেও বলা হচ্ছে, মোরশেদকে যাদের অবৈধ টাকার জন্য জীবন দিতে হয়েছে, এই ঘটনার নেপথ্যের খলনায়ক হিসেবে যার বা যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা যেন দেশ ছাড়তে না পারে, তার ব্যবস্থাও নেওয়া দরকার। কিন্তু এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না, নেপথ্যের খলনায়করা নজরদারিতে আছে কি না, তা জানা যাচ্ছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন-এর চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক ও মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “এ ঘটনার সঙ্গে হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী ওরফে শারুনের সংশ্লিষ্টতার খবর পাচ্ছি। মামলার বাদী তাদের ফ্ল্যাটে হামলা চালানোর সময় শারুনের উপস্থিতির কথা বলেছেন। রেডিসন হোটেলে শারুন ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদকে দেখা করতে চাপ সৃষ্টি করেন এবং টাকার আদায় নিয়ে এক বৈঠকেও তিনি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। এত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে পারছে কি না, সে প্রশ্ন এখন অনেকের। এ ছাড়া হুইপপুত্রের ‘সুনাম’-এর কথা আগেও আমরা জেনেছি। প্রশাসনকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো, বিশিষ্টজনকে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়াসহ আরো অনেক ‘সুনাম’ আছে তার। এমন লোকের যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে, সে অপরাধসংক্রান্ত মামলার ভবিষ্যত্ নিয়ে দুশ্চিন্তা তো থাকেই। ”

আখতার কবির চৌধুরী আরো বলেন, ‘ব্যাংক কর্মকর্তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার মামলায় পুলিশের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত ছিল দ্রুত এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার করে তাদের মাধ্যমে জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে ধরনের পদক্ষেপের তথ্য নেই। পুলিশের সক্ষমতার কথা আমরা জানি। মামলা হয়েছে; কিন্তু আসামি দ্রুত গ্রেফতার হয়নি—এ ধরনের নজির নেই। অথচ ব্যাংক কর্মকর্তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার মামলাটিকেই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলে মনে হচ্ছে। হয়তো কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার আশঙ্কায় পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ’

মামলার বাদী বলেছেন, ‘আমি আসামি গ্রেপ্তার দেখতে চাই। এজহারভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার হলেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য থেকে নেপথ্যের প্রভাবশালীদের নাম বেরিয়ে আসবে। ’

উল্লেখ্য, প্রভাবশালী একটি চক্রের গোপন ব্যবসার বলি হতে হয় তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ চৌধুরীকে। ২৫ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেও নিষ্কৃতি মেলেনি তার। তাকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ। ঘটনাটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এখন প্রধান আলোচনার বিষয়।

অনেকের ধারণা, রাজনৈতিক শক্তিধর একটি চক্র তাঁদের আয়ের টাকা ব্যাংকার মোরশেদ চৌধুরীর মাধ্যমে শেয়ার বাজার, কলমানি, খাতুনগঞ্জভিত্তিক ডিও ব্যবসা এবং গামের্ন্টের স্টক লট ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। সেই বিনিয়োগের টাকা এবং লাভের টাকা ফেরত নিতেই ‘রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত চাপ’ দেওয়া হয়। আর অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরেই মোরশেদ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

গত ৭ এপ্রিল আত্মহননের আগে সুইসাইড নোটে মোরশেদ উল্লেখ করেন ‘আর পারছি না। সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। কিছু লোকের অমানুষিক প্রেসার আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমার জুমকে (মেয়ে) সবাই দেখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ। ’

এ ঘটনায় মোর্শেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী বাদী হয়ে পাঁচলাইশ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। এতে মো. পারভেজ ইকবাল, জাভেদ ইকবাল, সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দীন ও রাসেলসহ অজ্ঞাত আট-দশজনকে আসামি করা হয়। গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের পরিদর্শক মঈনুর রহমানকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

শারুনের নাম মামলায় উল্লেখ কেন করেননি, এ প্রসঙ্গে ইশরাত জাহান চৌধুরী আগেই জানিয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। নেপথ্যের ওই ব্যক্তিদের নির্দেশেই সব কিছু হয়েছে। পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এজাহারভুক্ত আসামি পারভেজের কাছ থেকে তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ সহজেই পেয়ে যাবে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তার নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।

মঈনুর রহমান বলেন, ‘আমি বাদীর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিচ্ছি। আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
বাদী ইশরাত জাহান বলছেন, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা যেসব তথ্য জানতে চাইছেন, তা আমি জানাচ্ছি। কিন্তু আসামি গ্রেফতার দেখতে চাই আমি। ’
: কালের কণ্ঠ

Scroll to Top