বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভগ্নদশা দেখিয়ে দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা। ব্যাঙের ছাতার মতো হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠলেও নেই গুণগতমানের সেবা।
ফলে বাধ্য হয়ে রোগীদের ছুটতে হচ্ছে ঢাকায়। আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা ছুটছেন বিদেশে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতাল পরিচালনায় মানসম্মত চিকিৎসক ও দক্ষ জনবল না থাকায় চিকিৎসার মানোন্নয়ন করা যাচ্ছে না। তাছাড়া অর্থ উপার্জন মুখ্য হওয়ায় রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্ক ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর এলাকায় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৫৩টি। এরমধ্যে শুধু চট্টগ্রাম মহানগরেই ৯৩টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়া হাটহাজারীতে ১০টি, মিরসরাইয়ে ৮টি, ফটিকছড়িতে ৭টি, লোহাগাড়ায় ৬টি, সীতাকুণ্ড ও সাতকানিয়ায় ৫টি, পটিয়ায় ৪টি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বাঁশখালী ও চন্দনাইশে ৩টি, বোয়ালখালী, আনোয়ারা এবং সন্দ্বীপে ২টি করে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
এসব হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে মেলে নিম্নমানের চিকিৎসা সেবা। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে। বেশিরভাগ হাসপাতালে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ও আইসিইউ। এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ভালোমানের যন্ত্রপাতি না থাকা ও মেয়াদোত্তীর্ণ রিঅ্যাজেন্ট ব্যবহারে পাওয়া যায় ত্রুটিযুক্ত ডায়াগনসিস রিপোর্ট।
সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ও আইসিইউ সংকট
চট্টগ্রামে যত্রতত্র হাসপাতাল গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ হাসপাতালে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন সুবিধা। এমনকি চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিৎসা কেন্দ্র চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে বছরখানেক আগেও ছিল না সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন। করোনা মহামারি শুরুর পর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় এই হাসপাতালে চালু করা হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ। শুধু জেনারেল হাসপাতাল নয়, বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখনও নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন। আবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধার অপ্রতুলতা সবার চোখে ধরা পরে করোনাকালীন সময়ে।
ত্রুটিযুক্ত ডায়াগনসিস রিপোর্ট
চট্টগ্রামে প্রায়শই ভুল ডায়াগনসিস রিপোর্টের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে রোগীর স্বজন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটে বাগবিতণ্ডা। বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অদক্ষ জনবল ও নিম্নমানের রি-অ্যাজেন্ট ব্যবহার করায় রোগের সঠিক ডায়াগনসিস রিপোর্ট পাওয়া যায় না। ফলে ভুল চিকিৎসা পায় রোগীরা। অন্যদিকে প্যাথলজি বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত ল্যাবে পরীক্ষার ফলাফল যাচাই না করে কথিত টেকনোলজিস্ট দিয়ে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট সম্পন্ন করার অভিযোগও পাওয়া যায়।
বেসরকারি হাসপাতালের দৌরাত্ম্য
চট্টগ্রামে চিকিৎসা সেবার বিশাল একটি অংশ দখল করে আছে বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারি হাসপাতালে সেবার অপ্রতুলতায় আধিপত্য দেখাচ্ছে এসব বেসরকারি হাসপাতাল। উন্নতমানের চিকিৎসা সেবার কথা বলা হলেও সেবার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেট।
বিশেষায়িত হাসপাতালের অভাব
রাজাধানী ঢাকায় বিভিন্ন রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে নেই সরকারি কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল। ফলে রোগীদের বাধ্য হয়ে ছুটতে হয় ঢাকায়। বিশেষায়িত হাসপাতাল হলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন হতো বলে মত সংশ্লিষ্টদের। যদিও বেসরকারি উদ্যোগে ডায়াবেটিস, কিডনি, চক্ষুরোগের হাসপাতাল রয়েছে চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ইসমাইল খান বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে চট্টগ্রামে বিশেষায়িত হাসপাতাল হওয়া জরুরি। তবে তার আগে সরকারি যেসব হাসপাতাল রয়েছে সেসব হাসপাতালে চিকিৎসার মান এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। এসব হাসপাতাল উন্নত হলে চিকিৎসা সেবা নিতে রোগীকে ঢাকামুখি হতে হবে না।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যসেবার মান ঠিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের বিষয়ে কাজের অগ্রগতি রয়েছে। এরমধ্যে শিশু হাসপাতাল, ক্যান্সার হাসপাতাল, বার্ন ইনস্টিটিউট এবং আগ্রাবাদ-হালিশহর এলাকায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামিতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে যেতে পারবো। সীমিত সম্পদের মধ্যে কিভাবে রোগীদের ভালো সেবা দেওয়া যায় সেই চেষ্টা আমাদের রয়েছে।
: বাংলানিউজ