গ্রামীণ ফৌজদারী বিরোধ-বিবাদ দ্রুততম সময়ে ও ছোট-খাট দেওয়ানী, স্বল্প ব্যয়ে, খুব সহজে নিস্পত্তি করার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, গ্রাম আদালত আইন-২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) ও গ্রাম আদালত বিধিমালা-২০১৬ প্রণয়ন করে সরকার।
গ্রাম আদালতের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে ‘অ্যাকটিভেটিং ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ’ পাইলট প্রকল্পের (২০০৯-২০১৫) অর্জিত সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে সরকার ইউএনডিপি, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এর আর্থিক ও কারিগরী সহযোগিতায় ৫ বছর মেয়াদী (২০১৬-২০২০) বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প দেশের ৮টি বিভাগের ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নে বাস্তবায়ন করছে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার ৫টি উপজেলার (সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) ৪৬টি ইউনিয়নে বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পটি চলমান রয়েছে।
স্থানীয় সরকার, চট্টগ্রাম অফিস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় এ প্রকল্পের আওতায় গত তিন বছরে (জুলাই ২০১৭ থেকে জুন ২০২০) প্রকল্পভূক্ত ৪৬টি ইউনিয়নে সর্বমোট ৫ হাজার ৫৬৭টি মামলা গ্রহণ, ৫ হাজার ৩১১টি বিরোধ (৯৫.০৪ ভাগ) নিস্পত্তি করা হয়েছে।
নিস্পত্তিকৃত মামলাসমূহের মধ্যে ৩ হাজার ৭৪৮টি (৭০.৫৮ ভাগ) মামলা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব হয়েছে এবং অবশিষ্ট ১ হাজার ৫৬৩টি (২৯.৪২ভাগ) মামলা বাতিল, খারিজ, আবেদন ফেরত প্রদান বা উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়েছে। গ্রাম আদালতের ৩ হাজার ৭৪৮ সিদ্ধান্তের মধ্যে ২ হাজার ৭৬৪টি (৭৩.৭৫ ভাগ) সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। তিন বছরে ৫২১টি (৯.৩৬ ভাগ) মামলা জেলা আদালত থেকে গ্রাম আদালতে বিচারের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল।
গ্রাম আদালতে ১ হাজার ৯৬০ জন নারী (৩৫.২১ ভাগ) বিচার প্রার্থনা করেছেন এবং ৭৫৯ জন (১১.৭১ ভাগ) নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিচারিক প্যানেলে সদস্য ছিলেন। গত তিন বছরে ১৩৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী), দলিত (হরিজন) ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি গ্রাম আদালতে বিচারের জন্য আবেদন করেছেন এবং এই তিন বছরে ৫৩ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (আদিবাসী), দলিত (হরিজন) ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিভিন্ন মামলার প্রতিবাদী ছিলেন।
গ্রাম আদালতের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৭৬.৫৯ শতাংশ জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১ কোটি ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। গত তিন বছরে প্রকল্পভুক্ত গ্রাম আদালতসমূহে সর্বমোট ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৩ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ সময়ে ইউনিয়ন পরিষদসমূহ ৭০ হাজার ২৩০ টাকা ফি আদায় করেছে।
স্থানীয় সরকার, চট্টগ্রাম এর উপ-পরিচালক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় প্রকল্পভূক্ত ইউনিয়নসমূহের গ্রাম আদালতসমূহ অধিকতর সক্রিয়ভাবে চলমান রয়েছে। প্রকল্পবহির্ভূত ইউনিয়নগুলোতেও গ্রাম আদালত সক্রিয়ভাবে চলমান রাখার জন্য স্থানীয়ভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রাম আদালতে গরিব ও অসহায় মানুষ স্বল্প সময়ে অল্প খরচে ন্যায়বিচার পাচ্ছে। জেলার সব ইউনিয়নে (১৯১টি) গ্রাম আদালত কার্যক্রমকে শক্তিশালী, গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য স্থানীয় সরকার, চট্টগ্রাম এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
‘ইতোমধ্যে সকল ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের গ্রাম আদালত বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি সকল ইউনিয়ন পরিষদকে প্রয়োজনী উপকরণ/সহায়িকা সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আউটরিচ কার্যক্রমসহ প্রশাসনিক তদারকি অব্যাহত রয়েছে। ’
তিনি বলেন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সরকারের একটি অন্যতম অঙ্গীকার, তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম আদালতের সুনাম ও কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সার্বিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত বিচারিক সেবা পৌঁছে দিতে, স্থানীয় পর্যায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সকল স্টেকহোল্ডারদেরকে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদসমূহকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদসমূহ এই আইনের আওতায় নিয়মিত গ্রাম আদালত পরিচালনা করলে এ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো থানায় বা জেলা আদালতে দায়ের করার প্রয়োজন হবে না। এতে দেশের মূলধারার বিচারিক আদালতগুলোর মামলার জট অনেকাংশে হ্রাস পাবে।