মহামারী করোনার প্রভাবে স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা। এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছিল গত এপ্রিল মাসে। কারণ এপ্রিলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি এবং রপ্তানি দুই খাতেই বড়ধরনের ধস নেমেছিল; এর মধ্যে সবচে বেশি ধস নেমেছিল পণ্য রপ্তানিতে। কিন্তু এপ্রিল পেরিয়ে মে মাসে রপ্তানিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে; মে মাসের আমদানি-রপ্তানি গত এপ্রিলের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যদিও এর আগের মাসগুলোর তুলনায় এই বৃদ্ধি হার খুব বেশি নয়। এরপরও করোনা আতঙ্কের মধ্যে একে সুখবর হিসেবেই দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।
দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কেমন চলছে তার বড় একটি ধারণা পাওয়া যায় চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য ওঠানামার চিত্র দিয়ে। অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানির ৮২ শতাংশ আসে; আর রপ্তানি পণ্যের ৯১ শতাংশই যায় এই বন্দর দিয়ে। সুতরাং এপ্রিল মাসে এই বন্দরে পণ্য ওঠানামায় ধস নামায় যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছিল; তেমনি মে মাসে রপ্তানি বাড়ায় আশান্বিত হয়ে উঠছেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম বলেন, এপ্রিলে করোনার কারণে আমদানি কমেছে ঠিক কিন্তু কাস্টমসের অস্পষ্ট নির্দেশনার কারণে এপ্রিলে যেই পরিমাণ আমদানি হয়েছে সেই পরিমাণ পণ্য বন্দর থেকে ছাড় দিতে পারিনি। কন্টেইনার জটের কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত ২৩টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করতে পারিনি। মে মাসে সেই জটিলতা না থাকায় আমদানি ও রপ্তানি দুই খাতেই অগ্রগতি হয়েছে।
বন্দরের এই কর্মকর্তা মনে করেন, জুন মাসেও আমদানি-রপ্তানি দুই খাতেই অগ্রগতি বহাল থাকবে। আমদানিকারকদের তথ্যমতে আগে থেকে ঋণপত্র খুলে রাখা বেশ কিছু পণ্য এই জুনে চট্টগ্রাম পৌঁছবে। আবার বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দিতে শুরু করায় রপ্তানির ধারাও অব্যাহত থাকবে।
গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও আরএসবি ইন্ডাষ্ট্রিয়াল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশও রপ্তানি নিয়ে আশা দেখছেন। তিনি বলেন, সরকার ২৬ এপ্রিল থেকে কারখানা খুলে দেয়ার কারনেই মে মাসে রপ্তানিতে সুফল এসেছে। এখন যে অর্ডার আসছে এবং আগে যে অর্ডার এসেছে তাতে জুন মাসেও এই ধারাবাহিকতা থাকবে। তবে পণ্য রপ্তানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে বছর দেড়েক সময় লেগে যাবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি সর্বোচ্চ মেনে আমরা কারখানা চালু রেখেছি। কারখানা যদি না খুলতো তাহলে এই অর্ডার অন্য দেশে চলে যেতো; আমরা দেরিতে কারখানা খুললে রপ্তানির এই সুফল পেতাম না।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনকারী শিপিং লাইনগুলোর তথ্যমতে, গত মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৬১ হাজার একক কন্টেইনার; এপ্রিল মাসে রপ্তানিতে ধস নেমে তা মাত্র ১৩ হাজার একক কন্টেইনারে নেমে আসে। তবে মে মাসে আবার রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার একক কন্টেইনার; যা এপ্রিল মাসের দ্বিগুণ; যদিও মার্চ মাসের চেয়ে অনেক কম।
অনুরূপভাবে আমদানি পণ্য আসার ক্ষেত্রেও মে মাসে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। মে মাসে আমদানি পণ্যভর্তি কন্টেইনার এসেছে ৯৬ হাজার ৬শ একক; এপ্রিলে সেটি ছিল ৭০ হাজার একক এবং মার্চ মাসে ছিল ১ লাখ ১০ হাজার একক কন্টেইনার। আমদানি-রপ্তানির মোট হিসাবে ইতিবাচক প্রভাব এসেছে।
জানতে চাইলে বিদেশি জাহাজ পরিচালনাকারী জিবিএ· লজিস্টিকস লিমিটেডের এসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনতাসির রুবাইয়াত বলেন, ‘আমাদের হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১৩১ শতাংশ; আর একই সময়ে আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। মূলত তৈরী পোশাক শিল্পসহ কারখানা খুলে দেয়ায় রপ্তানি বেড়েছে। আর ঈদের আগে সেই সাথে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি বিপুল পরিমান কোভিড-১৯ এর প্রতিরোধক পণ্য রপ্তানি হয়েছে।’
তবে আমদানির বিষয়ে তিনি বলছেন, জুন থেকে আমদানির গতি ধীর হবে মনে হচ্ছে। আগে শুধু সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে জাহাজভর্তি কন্টেইনার চট্টগ্রাম আসতো। কিন্তু এখন একাধিক বন্দর ঘুরে জাহাজভর্তি করে চট্টগ্রাম আসছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যও আগামীতে আমদানি কমার তথ্য দিচ্ছে। ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য মাত্র ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। এই অঙ্ক গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ২৬৮ শতাংশ কম। আর গত মার্চ মাসের চেয়ে কম ২৬৩ শতাংশ।
গত ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ৫২৬ কোটি (৫.২৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। আর গত মার্চ মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪৯৭ কোটি ডলারের। গত মার্চ মাসেই করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণার পর বিশ্বের অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। এই পরিস্থিতি বিশ্বকে আরেকটি মহামন্দার দিকে টেনে নিচ্ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অবস্থা উত্তরণে আমদানি প্রবাহের ওপর নিয়মিত তদারকির আহবান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলছেন, খাদ্যপণ্যসহ জরুরি পণ্যের চাহিদা, সরবরাহ এবং আমদানি ঠিক রাখার দিকে তীক্ষ্ণ নজর বাড়াতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামার হিসাবেও মে মাসে আমদানি-রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে পণ্য উঠানামা হয়েছে অনেক বেশি। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য উঠানামার তথ্যের সাথে শিপিং লাইনগুলোর তথ্যের সামান্য পার্থক্য রয়েছে। মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যভর্তি কন্টেইনার উঠানামা হয়েছে এক লাখ ১ হাজার একক; এপ্রিল মাসে ছিল প্রায় ৭২ হাজার একক। আর রপ্তানি পণ্যভর্তি কন্টেইনার জাহাজীকরন হয়েছিল ৩৩ হাজার ৮শ একক; এপ্রিলে সেটি ছিল ১৪ হাজার ৭শ একক।
তথ্যের পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর পণ্য উঠানামার হিসাব করে বন্দরের আওতাধীন ঢাকা আইসিডি এবং পাঁনগাও কন্টেইনার টার্মিনালে পণ্য উঠানামা যোগ করে। আর শিপিং লাইন হিসাব করে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজীকরনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।