হামলার ২৪ ঘণ্টা পরও জ্ঞান ফেরেনি বরিশাল বিএম কলেজের অনার্সের ছাত্রী শান্তা খানমের। তার নাক, কান, ঠোঁট, ঘাড়, গলাসহ পুরো মুখমণ্ডল ও মাথা ক্ষুরের পোঁচ দিয়ে এমনভাবে ফালা ফালা করা হয়েছে যে জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত চিকিৎসকরাও বলতে পারছেন না ক্ষতস্থানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে।
দারিদ্র্যপীড়িত, নিরীহ স্বভাবের এবং শিক্ষকের ভাষ্য অনুযায়ী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী শান্তার এই করুণ হাল করেছে বখাটেরা। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক বখাটে দলবল নিয়ে পিতৃহীন মেয়েটির ওপর এ পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে।
পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কাছে এই হামলা চালায় বখাটেরা। আক্রান্ত শান্তা বিএম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছিল। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে মূল অভিযুক্ত এখনো ধরা পড়েনি।
আহত শান্তা খানম বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্নপুর ইউনিয়নের মিশ্রিপাড়া গ্রামের মৃত প্রতিবন্ধী গোলাম মোস্তফার মেয়ে। তার পরিবারের অভিযোগ, আলাল সরদার (২৬) নামের এক বখাটে দুই বছর ধরে শান্তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছে।
তাতে সাড়া না দেওয়ায় সে শান্তার ওপর এ হামলা চালিয়েছে। অভিযুক্ত আলাল সরদার জেলার উজিরপুরের শোলক ইউনিয়নের কাংসি গ্রামের ফজলু সরদারের ছেলে। আলাল ঢাকায় একটি রেস্তোরাঁয় বয় হিসেবে কাজ করে।
আগৈলঝাড়ার রত্নপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সরদার বলেন, শান্তার দাদা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিববাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তার বাবা মৃত মোস্তফা হাওলাদার প্রতিবন্ধী ছিলেন। তাই গোটা পরিবারের হাল ধরেছিলেন তার মা। অভাবী সংসারের শান্তা মেধাবী হওয়ায় এলাকাবাসীর সহায়তায় পড়াশোনা করে আসছিল। চার ভাই-বোনের মধ্যে শান্তা সবার বড়। এক বোন আর দুই ভাই, সবাই পড়ালেখা করে। তাদের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।
হামলার পর শান্তাকে প্রথমে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে শনিবার রাতেই তাকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রণবীর দাস বলেন, ওই ছাত্রীর মুখমণ্ডলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তার কপাল, নাক, কান, গলা, ঠোঁট ও গালে গভীর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার মুখমণ্ডলে প্রায় ১৬টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। এখনো (গতকাল রবিবার রাত ৯টা পর্যন্ত) তার জ্ঞান ফেরেনি। যে অংশগুলোতে আঘাত করা হয়েছে তার অবস্থা কী রকম তা জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত বলা যাবে না।
এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা নিলুফা বেগম প্রধান অভিযুক্ত আলাল সরদারসহ চারজনকে আসামি করে গতকাল উজিরপুর থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামি আলালের সহযোগী উপজেলার উত্তর ধামুরা গ্রামের নুরু হাওলাদারের ছেলে ককটেল মিরাজ ও মধ্য ধামুরা গ্রামের মাসুদ হাওলাদারের ছেলে সৌরভ ওরফে কালুকে আটক করেছে। তবে প্রধান অভিযুক্ত আলাল সরদার ও অন্য আসামি উপজেলার গজেন্দ্র গ্রামের শাকিল হোসেন মোল্লাকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
শান্তার বান্ধবী টুম্পা আক্তার জানায়, তাদের সম্মান প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাদের পরীক্ষা শেষ হয়। পরীক্ষা শেষে সে, শান্তা ও পাপিয়া বরিশাল নগরী থেকে বাসযোগে উজিরপুরের ইছলাদি বাসস্ট্যান্ডে নামে। এরপর একটি ভ্যানে করে তারা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার দিকে তাদের ভ্যানটি ধামুরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কাছে পৌঁছে। সেখানে একটি নির্জন স্থানে বখাটে আলাল সরদারসহ কয়েকজন যুবক ভ্যানটি থামায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা শান্তাকে একটি ক্ষুর দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। টুম্পা বলে, ‘এ সময় আমরা চিত্কার দেওয়া শুরু করলে আমাদের চর-থাপ্পড় দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। পরে স্থানীয়রা এসে শান্তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। ’
ছাত্রীর মা নিলুফা বেগম বলেন, আলাল সরদার নিরক্ষর ও মাদকাসক্ত। সে তাঁর মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। তাতে তাঁর মেয়ে সারা না দেওয়ায় বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। তার জন্য কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল শান্তা। এরপর সে বাড়িতে এসে কয়েকবার হুমকি দেয়। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জেনে ফেলায় ক্ষিপ্ত হয়ে আলাল তাঁর মেয়ের ওপর হামলা করে।
উজিরপুর থানার ওসি (তদন্ত) হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘শান্তার মুখমণ্ডলে খুব খারাপভাবে ক্ষুর দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে আটক করেছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/নীল