বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর সহযোগী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) আদর্শ বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উঠে এসেছে এমন তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরদিন (৯ আগস্ট) হিন্দু সংখ্যালঘুরা ঢাকার শাহবাগ চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে আসে। হিন্দুদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়কে লক্ষ্য করে ধারাবাহিক আক্রমণের প্রতিবাদ জানাচ্ছিল তারা। ওই সময় বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (বিএইচজেএম) নামে একটি প্ল্যাটফর্মের উদ্ভব ঘটে।
বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চসহ আরও কয়েকেটি সংগঠন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে। কিন্তু এই সংগঠনগুলো ভারতের বিজেপি ও আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শে অবিচল। বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতারা ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এমনকি তারা ভারতের বিজেপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। ভারত সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই নেতারা হিন্দুত্ববাদী আদর্শের সাথে নিজেদের সংযোগ দৃঢ় করেছেন, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সাথে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের (এইচজেএম) নামের সাথে মিল রয়েছে। এই হিন্দু জাগরণ মঞ্চ আরএসএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর আরএসএস ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সহযোগী সংগঠন।
তাদের স্বঘোষিত মতাদর্শ হল হিন্দুত্ব, যাকে তারা ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করে। তারা একে জাতীয়তাবাদ বললেও তা ভারতের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল, তিব্বত থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বি্সতৃত কাল্পনিক একটি ‘অখণ্ড ভারত’ বা অবিভক্ত ভারতকে পুনরুদ্ধার করার ধারণাকে প্রচার করে এই সংঘ পরিবার। এর আগে নেপালেও হিন্দুত্বের প্রভাব পৌঁছেছে বলে জানা যায়। বিজেএইচএম নেতারা বাংলাদেশে অখণ্ড ভারতকে চিত্রিত করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এর মধ্যে গত ১ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ (বিএসজেএম) করা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মটি সামনে আসার পর বাংলাদেশের হিন্দুদের অন্যান্য সংগঠনগুলোর ভূমিকা কম দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ২০০৬ সাল থেকে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের শিকড় অনুসন্ধান করছেন। যখন ‘হিন্দু মহাজোট’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুত্বের প্রতি আগ্রহ বাড়তে শুরু করে এবং ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান, রাম নবমী উৎসবের আয়োজন ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
২০২১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ অনেককেই কট্টরপন্থী হিন্দুত্বের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এতে বিজেপি ও আরএসএসের আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালে হিন্দুদের সমর্থনে রাম নবমী ও জন্মাষ্টমী উৎসবে হিন্দুত্বের প্রচার করা হয়। ২০২৩ সালে জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোট নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম হিন্দুত্ববাদী ছাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেছেন, হিন্দুত্ব একটি হিন্দু ধর্মীয় আদর্শ। এর সীমানা থাকতে পারে না। আরএসএস বা বিজেপির সঙ্গে আমাদের কোনো সাংগঠনিক সংযোগ নেই। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষ-উদারবাদী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও জামায়াত-উল-মুজাহিদিনের মধ্যে পার্থক্য করে, তারা প্রথমটিকে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং পরবর্তীটিকে একটি সন্ত্রাসী দল বলে উল্লেখ করে । কিন্তু একই লোকেরা আমাদের আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।
এই রাজনৈতিক আন্দোলন ও হিন্দুত্ববাদী আদর্শের উত্থান বাংলাদেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যা ভবিষ্যতে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়াতেই কেবল হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে ভারতে প্রবল। নেপাল একসময় হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হলেও ২০০৮ সালে দেশটিতে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং নতুন সংবিধান লেখা হয়। প্রাচীন নেপাল হিন্দু রাজ্যের রেশ ধারণ করলেও সেটি এখন ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাকিগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তবে ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশে ভারতে সৃষ্ট হিন্দুত্ববাদের প্রচার-প্রসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাড়ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।