দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত বড় হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এই বাস্তবতায় দেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার সমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। অর্থাৎ এই সময় প্রবৃদ্ধি হলেও তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।
প্রবৃদ্ধি যে হারে হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান হয়নি। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আইএলও বলছে, দেশের উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের হার কমেছে। তার প্রভাব পড়েছে সেবা খাতেও। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি মজুরি; বরং প্রকৃত মজুরি কমেছে ৫ শতাংশ।
কর্মসংস্থান ও মজুরির এই পরিস্থিতির সঙ্গে চাকরি নিয়ে তরুণদের হতাশার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। বেসরকারি খাতে শোভন কর্মসংস্থান বাড়েনি বলেই সরকারি চাকরি এখন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ছাত্রদের বড় একটি অংশ মনে করেছে, সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে তাঁদের সুযোগ কমে যায়।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ফর ইয়ুথ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা বিশ্বেই তরুণদের বেকারত্ব কিছুটা কমেছে। কিন্তু সেখানে কোনো দেশের সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। আইএলওর ঢাকা কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বড় হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে। সেই সঙ্গে ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ থেকে আরও কিছু উদ্বেগজনক তথ্য দেয়। যেমন দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশের বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তরুণদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং তরুণীদের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন।
অর্থাৎ দেশের তরুণদের মধ্যে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ও তরুণীদের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বা শোভন কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। বাকি তরুণেরা কাজ করছেন ঠিকই, হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে ভালো রোজগারও করছেন, কিন্তু তাঁদের জীবনের প্রতি পদে পদে আছে অনিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে আছে যথাযথ কর্মপরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার পর্যন্ত নেই।
সামগ্রিকভাবে দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। বাকিরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০০০ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ২০০০ সালে যেখানে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কাজ করতেন; এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। জিডিপিতে এই খাতের অবদান ৩০ শতাংশের বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের উপস্থিতি টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের রাজস্ব আয়ে ভূমিকা রাখে না। আর তা যেন করতে না হয়, সে জন্য তারা ছোটই থাকতে চায়। এরা যেমন ব্যাংক ঋণ বা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন পায় না, তেমনি তাদের উৎপাদনশীলতাও কম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটা জায়গায় থমকে যায়। সেই সঙ্গে এসব খাতে যারা কাজ করে, তাদের আয়-উপার্জন ও কর্ম নিরাপত্তাও কম।
আইএমএফ আরও বলছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের এই বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সমাজে অসমতা বেড়ে যায়। দেখা যায় একই দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কম মজুরি পান। তবে নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরও বেশি। আইএমএফ লাতিন আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, এই অঞ্চলে গত ২০ বছরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সংকোচনের সঙ্গে অসমতাও কমেছে।
অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতা ঠিক এর বিপরীত। এখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণ হয়েছে। একদিকে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা এবং আরেক দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে যত ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। মোদ্দাকথা হলো, এতে টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার দিন দিন বড় হচ্ছে। গত বছর গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক হিসাবে জানানো হয়, ২০১০ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে পাওয়া যেত না এমন করের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮৪ হাজার কোটি টাকার কর ক্ষতি হচ্ছে। এ টাকা পাওয়া গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় তিন গুণ বাড়ানো যেত। করজাল বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। দেশে যে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে, তার জন্য এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্প্রসারণের যোগ আছে।
গত ১৫ বছরে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেই অর্থের একটি অংশ বিদেশে পাচার হওয়ার পাশাপাশি কিছু দেশের ভেতরেও বিনিয়োগ হয়েছে। নির্বাচনের হলফনামায় দেখা যায়, রাজনীতিবিদদের অনেকের মূল পেশা মৎস্য চাষ ও কৃষি। রাজনীতিবিদদের মূল পেশা মৎস্য চাষ হওয়ার পেছনে দুর্নীতি বড় কারণ। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে যে অকৃষি খাতের বিকাশ হচ্ছে, তার সঙ্গেও এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যোগ আছে বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সেই সঙ্গে আছে প্রবাসীদের পাঠানো প্রবাসী আয়; যার উৎপাদনশীল ব্যবহার খুব কম।
দেশে কৃষি, মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণকাজ, হকার, চাতাল, সেলাই কাজ, ওয়েল্ডিং, তাঁত, বিড়ি কারখানা, প্রিন্টিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, গৃহস্থালি কর্ম, ক্ষুদ্র কারখানা প্রভৃতি খাতকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে গণ্য করা হয়।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেভাবে হোটেল, রেস্তোরাঁ বা ছোট কারখানা গড়ে উঠছে, তার সঙ্গে দুর্নীতি বৃদ্ধির যোগ আছে।
বিশ্বব্যাংক এক সময় সহজে ব্যবসার সূচক প্রণয়ন করত। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকেই থাকত। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রণীত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্সে (বিবিএক্স) বাংলাদেশের অবস্থার অবনতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরাও সব সময় এ নিয়ে সোচ্চার। ফলে বেসরকারি খাতে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি খুবই কম।
সরকারি চাকরি ও কোটা সংস্কার
সরকারি চাকরির প্রতি যে তরুণদের আকর্ষণ বাড়ছে, তা বিস্ময়কর কিছু নয়। চাকরির নিরাপত্তার সঙ্গে ক্ষমতাও বড় বিষয়। গত দেড় দশকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে এখন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক তরুণ স্নাতক হয়ে বেরোচ্ছেন, তাঁদের শোভন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অনেকেই বাধ্য হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ঝুঁকছেন বা স্বকর্মসংস্থানে যাচ্ছেন। উদ্যোক্তা হওয়াও সহজ কাজ নয়।
আরেকটি বিষয় বলা দরকার, প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আয় বেশি। কিন্তু শিক্ষিত তরুণেরা সেই কাজে যান না; এটা একধরনের কাঠামোগত অসামঞ্জস্য তৈরি করছে।
গত দেড় দশকের বড় সময়জুড়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথ সংকীর্ণ। তার সঙ্গে গত দেড় দশকে লাগামহীন দুর্নীতির কারণে যে অসমতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও মানুষের মনে বঞ্চনা বোধ তৈরি করেছে। বঞ্চনার সেই স্ফুলিঙ্গ সম্ভবত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবানলের রূপ নেয়।