গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে প্রধানত হচ্ছে- শিক্ষা খাত ঢেলে সাজানো, স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য বন্ধ, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে শৃঙ্খলা ফেরানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, থানা পুলিশের কাজ শুরু করা, অর্থনীতি ব্যবসাবাণিজ্য চাঙা রাখা, ইসি, দুদক, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশনে শৃঙ্খলা আনা।
দেশকে এগিয়ে নিতে সতর্ক এবং সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে সংস্কারের সমীকরণ হয়ে উঠতে পারে জটিল। তাই সরকারের জন্য সামনের দিনগুলো সহজ হবে না বলে পূর্বাভাস বিশ্লেষকদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন এ সরকার এমন সময়ে দায়িত্ব নিচ্ছে যখন ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রশাসন এবং অন্যান্য সেক্টরেও চলছে অস্থিরতা। আছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। এর সঙ্গে আছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশা। সব মিলিয়ে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সরকার পতনের পর দেশের প্রায় সব থানা থেকে সরে যান পুলিশ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা। মূলত আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে বহু মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার থানায় উত্তেজিত জনতার হামলায় পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট এখন প্রকট। বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ডাকাতি, লুটপাট, ভাঙচুর।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তার মিত্রদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হচ্ছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানাচ্ছে মানবাধিকার গোষ্ঠী ও কূটনীতিকরাও। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্মৃতি সিংহ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ তৈরি করে দেওয়া। একই সঙ্গে নতুন করে যাতে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভিতরে যে দুর্নীতি, নির্যাতনের সংস্কৃতি এবং জনগণের সেবা না পাওয়ার ইতিহাস সেটা বদলাতে হবে। কোনো অনিয়ম হলে সেটার প্রতিকার যদি হয়, তাহলে মানুষের আস্থা ফিরবে। এক্ষেত্রে আগে সরকারের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। সরকার আসলে এসব বাহিনীকে ব্যবহার করে। সুতরাং সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিবর্তন হলে বাহিনীর ভিতরেও সংস্কার আসবে। এসব বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষের মনে শান্তি ফেরানো। যাতে মানুষ রাতে নির্ভয়ে ঘুমাতে পারে, চলাচল ও নিজের কাজ করতে পারে। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কোনো সম্প্রদায়ের যেন আর ক্ষতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
জানা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জনজীবনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণ আস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশ নেওয়ার পেছনে সেটাও একটা বড় কারণ বলেই উঠে এসেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় সম্পর্কে বলেন, ‘এ মুহূর্তে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই আশু করণীয় কাজ। মানুষের জানমাল রক্ষা করা ও দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা। সব ধরনের নৈরাজ্য দূর করা এবং যারা এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ মুহূর্তে আমাদের পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তাই এটাকে আবার পুনঃস্থাপন করে শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।’
নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মানবাধিকার কমিশন যেন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে চলছে জোর আলোচনা। বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার ওপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের আগেই এসব বিষয়ে এখন সংস্কারের তাগাদা দিচ্ছেন অনেকেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সব প্রতিষ্ঠানকেই এখন কমবেশি সংস্কার করতে হবে। দেশে দুর্নীতি বড় সমস্যা। সুতরাং দুর্নীতি দমন কমিশনের কী হবে, বিচার বিভাগের কী সংস্কার হবে, র্যাব থাকবে কি না এরকম অনেক বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। সাংবিধানিক যত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেভাবে সংস্কার করতে হবে। তাহলে সেটা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে দুর্নীতির মতো কাজ থেকে দূরে রাখবে। অতীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার হতে হবে দলনিরপেক্ষ। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। বিশেষ করে যেসব বিষয় নিয়ে জনমানুষের ক্ষোভ, এগুলো নিরসন করতে হবে। রাষ্ট্রের সবখানে বিদ্যমান অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ভালো কাজে যেমন উৎসাহ দিতে হবে, তেমনি আমাদেরও সঠিক দায়িত্বটা পালন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে একই ব্যক্তিকে বারবার দায়িত্ব দেওয়া, তদবির-লবিং করে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া- এসব বন্ধ হতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাজপথ আগলে ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে গণমানুষের আন্দোলনে রূপ দিয়েছে এই তরুণ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গাছ লাগানো, আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার বার্তা দিচ্ছেন এ শিক্ষার্থীরা। এ শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে জোর দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘অনেক রক্তক্ষয় ও প্রাণ ক্ষয়ের পরে দেশে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। আমার প্রত্যাশা ড. ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী বিশ্বের সম্মানিত ব্যক্তির নেতৃত্বে তরুণ-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত এ নতুন সরকার দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। বিগত দিনে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেগুলো শুধরে রাষ্ট্র কাঠামোয় সংস্কার এনে মানুষকে একটা বৈষম্যহীন সুন্দর জীবন উপহার দেবে তারা।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগে বেহাল দশা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব হাসপাতালে আসছেন না অধিকাংশ ডাক্তার। এতে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনদের। অধিকাংশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানেই পরিচালক-মহাপরিচালকসহ চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশির ভাগই আতঙ্কে কর্মস্থলে আসছেন না। হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বাড়ছে, দীর্ঘ হচ্ছে অপারেশনের সিরিয়াল। দলাদলি বাদ দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চিকিৎসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশ সংকটময় সময় পার করছে। এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালে আসছেন না অনেক চিকিৎসক। মানুষের রোগ তো আর বসে থাকবে না। স্বাস্থ্যসেবাকে রাজনীতির মধ্যে না এনে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কিংবা বিএনপি সমর্থিত সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) কোনোটিরই দরকার নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে চিকিৎসকদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এগিয়ে আসতে হবে।’