মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার আগে দরকার

‘আই হেইট পলিটিকস’ প্রজন্ম, মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকা প্রজন্ম, কেবল ‘আমি-আমি’ করা প্রজন্ম—আরও কত কী ‘অপবাদ’ ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। অথচ এই কিশোর-তরুণেরাই জেগে উঠেছেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলনের শুরু, এখন তা রাষ্ট্র সংস্কারের পথে এগোচ্ছে। কী সংস্কার চান তাঁরা? কোন কোন ক্ষেত্রে কী পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন?

গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এক নম্বরে রাখব

সৈয়দা মেহরীন মোকাররম ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দা মেহরীন মোকাররম, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই আমি এক নম্বরে রাখব। এটি সংবিধান স্বীকৃত এবং একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে এটাই চায় মানুষ। সংবিধানের ৩৯ (১) ও (২) ধারায় এই নাগরিক অধিকার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে, যা এর আইনি প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনামলে আমরা দেখেছি, এ অধিকার চর্চাও যেন গুরুতর পাপ। শুধু সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরকারের আলোচনা-সমালোচনা করার আগে অনেকবার ভাবতে হতো। কী জানি কোন দিন গুম হয়ে যাই! পথেঘাটে হয়রানির শিকার হই! পরিবর্তন যে অন্য বিষয়ে দরকার নেই, তা নয়। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার আগে দরকার। কারণ, যে সরকার আমার সাহায্য করবে, দাবি মানবে; তাদের কাছে যদি আমাদের আওয়াজ-চাওয়া পৌঁছাতে না পারে, তাহলে অন্যান্য বিষয়ে পরিবর্তনের সুযোগ কীভাবে পাব! শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন, আমলাতন্ত্র, বেতন-ভাতা ইত্যাদি ক্ষেত্রের সমস্যা এবং এসব ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া অনিয়ম তখনই পরিবর্তন হতে পারে; যখন আমরা আওয়াজ তুলব। গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানাব। তাহলে বাকি সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবে।

বিচার বিভাগ যেন আদতেই রাষ্ট্রের অভিভাবক হয়ে ওঠে

যোনায়েদ আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

যোনায়েদ আহমেদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষার লড়াই বাংলাদেশের জন্মের পেছনে বড় ভূমিকা রাখলেও বাংলা ভাষাটাই রয়ে গেছে আয়নাঘরে। এমনকি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের দাবিদাওয়াগুলোর আজও বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অন্যতম দায়িত্ব হবে বাংলা ভাষায় জাতীয় শিক্ষাক্রমকে নতুনভাবে বিন্যাস, সৃষ্টি ও কার্যকর করে একুশ শতকের উপযোগী করে তোলা। সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হবে জ্ঞানার্জন; শিক্ষকদের অনুগত ছাত্র বা আমলা তৈরির কারখানা নয়। শিক্ষক নিয়োগেও আনতে হবে পরিবর্তন। সরকারি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন দেশের মেধাবীরা সেদিকে আকৃষ্ট হয়। ছাত্র–জনতার বিপ্লববিরোধী অনুচ্ছেদ যেমন, অনুচ্ছেদ ৭০, ৭ক এবং ৭খ অবিলম্বে বাতিল করা উচিত৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো বৈষম্যমূলক ও মানবতাবিরোধী আইন এবং এদের চর্চাকারী সংস্থা র‍্যাবের বিলুপ্তি, পুলিশ সংস্থার গণতন্ত্রায়ণ ও অন্যান্য আইন বলবৎকারী সংস্থার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিচার বিভাগ যেন আদতেই রাষ্ট্রের অভিভাবকরূপে কাজ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী, স্বাধীন ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পারলেই এই সংগ্রাম সার্থক হবে

সামিউল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

সামিউল ইসলাম, রসায়ন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

২০২৪ সালে এসে আমরা পেয়েছি একটি নতুন সূর্য, এক নতুন বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের এই অর্জন তখনই সার্থক হবে, যখন বাস্তবিক অর্থে আমরা অসাম্প্রদায়িকতাকে বুকে ধারণ করে দেশ গড়ে তুলতে পারব। এই নতুন বাংলাদেশ যেমন মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের মানুষের; তেমনি সমতলের বাঙালি ও পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর। যদি আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারি, সব সময় বিজয়ী হব। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে যেকোনো বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারব। সুতরাং নতুন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম যে পরিবর্তন দরকার, সেটা হলো সব জনগোষ্ঠী ও ধর্মের লোকজনের ভেতর সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করা; জাতিগত বৈষম্য ভুলে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তবেই সার্থক হবে স্বৈরাচার, বৈষম্যবিরোধী দীর্ঘ এই সংগ্রাম, অগণিত শহীদের আত্মত্যাগ।

Scroll to Top