‘আমার সারা শরীর পোড়া, কেউ আর ধর্ষণ করতে পারবে না’

তীব্র যন্ত্রণা তার সারা শরীরে। মুখ বাদে পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। নয়া দিল্লির একটি হাসপাতালে টান টান শুয়ে আছেন সুনীতা (পরিবর্তিত নাম)। তার শরীরের ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ পুড়ে গেছে। তবু কোনোমতে বেঁচে আছেন তিনি। মৃদুকণ্ঠে হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি বলেছেন, আমি মরতে চেয়েছিলাম। এই যন্ত্রণা কেউ সহ্য করতে পারবে না। এখন আমার সারা শরীর পোড়া। তাই ন্যূনতম কেউ আমাকে আর ধর্ষণ করতে চাইবে না এখন। বলতে বলতে সুনীতার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।

ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ক্ষত তাকে আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ করেছিল। তাই ২৮ এপ্রিল উত্তর প্রদেশে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তিনি নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। কিন্তু মারা যান নি সুনীতা। আগুনে পোড়ার পর বাংলাদেশের ফেনির নুসরাতের মতো অবস্থা হয়েছে তার। তিনি নয়া দিল্লির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানে তার সঙ্গে কথা হয় টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিকের। সুনীতা শোনান তার বেদনার কাব্য। বলেন, তার পিতা ও এক ‘আন্ট’ মিলে তাকে ১০ হাজার রুপিতে বিক্রি করে দিয়েছিল। যার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, সে ও অন্য কয়েকজনে মিলে ধর্ষণ করে সুনীতাকে। এ অভিযোগ নিয়ে তিনি উত্তর প্রদেশ পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ঠিক যেন নুসরাত জাহান রাফির মতো তিনিও পুলিশের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

২৩ বছর বয়সী সুনীতার জীবনে দুর্দশা নেমে আছে জীবনের প্রথম দিকেই। তিনি মৃদুকণ্ঠে বলেন, আমার বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর তখন ২০০৯ সালে বাবা আমাকে বিয়ে দেন। আমার স্বামীর বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে আমাকে ফেলে চলে যান। গতকালের রিপোর্টে টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, সুনীতার স্বামী মারা গেছেন এ তথ্যটি ঠিক ছিল না বলে মঙ্গলবারের রিপোর্টে জানানো হয়েছে।

সুনীতার স্বামী তাকে ফেলে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে বিক্রি করে দেয় তার পিতা, যাতে তিনি তার স্ত্রীর জন্য জিনিসপত্র কিনতে পারেন। যার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, বলা হয়, সে সুনীতার দ্বিতীয় স্বামী। এ সম্পর্কে সুনীতা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, আমার দ্বিতীয় স্বামী ছিল একটা শয়তান। সে ও তার বন্ধুরা মিলে আমাকে বার বার ধর্ষণ করেছে। তারা মনে করেছে আমি বিপদগ্রস্ত। আমার কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। কমপক্ষে ২০ জন আমাকে ধর্ষণ করেছে। তারা আমাকে এসিড মারার হুমকিও দিয়েছে।

কথা বলতে গিয়ে ব্যথার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় সুনীতার। তবু তিনি বেদনাভেজা কথাগুলো না বলে থাকতে পারেন না। তিনি জানান, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য তিনি কি পরিমাণ কঠোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি তা পান নি। সুনীতা বলেন, আমার পিতার কাছ থেকেও না, পুলিশের কাছ থেকেও না কারো কাছেই ন্যায়বিচার পাই নি। আমি আলাদা আলাদা অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু সব সময়ই আমাকে বিমুখ করা হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আমি ঘুরেছি। কোনো এফআইআর নিবন্ধন করা হয় নি। তাই আমি নিরুপায় হয়ে পড়ি এবং জীবন বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

সুনীতার দ্বিতীয় স্বামী তার পিতার বন্ধু। তার সম্পর্কে সুনীতা বলেন, সে আমাকে প্রতিদিন নিষ্পিষ্ট করতো। ধর্ষণ করতো। তার বন্ধুদের বাড়ির গৃহকর্ম করে দিতে বাধ্য করাতো। এতটুকু বলতে বলতে সুনীতি কথা হারিয়ে ফেলেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তবু তিনি বন্ধু রিশাবের (পরিবর্তিত নাম) প্রসঙ্গ টেনে আনেন। বলেন, জীবনের সব দুঃখ বেদনার কথা তিনি শুধু বন্ধু রিশাবের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

এ সম্পর্কে রিশাব বলেন, সুনীতার পিতামাতা, দুই ভাই ও এক বোন তাকে অস্বীকার করতো। এমন কেউ ছিল না, যার সঙ্গে সুনীতা তার কষ্টের কথা বলতে পারতো। এ সময়টাতে সে আমাকে সবচেয়ে কাছের করে পেয়েছে। একজন বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। একজন পার্টনার হিসেবে নিয়েছে। তাকে ছেড়ে যাওয়ার আমার কোনো পথই নেই। রিশাব বলেন, তার তিনটি সন্তান আছে। প্রথমটির পিতা সুনীতার প্রথম স্বামীর। দ্বিতীয়টির জন্মদাতা তার দ্বিতীয় স্বামী। আর তাকে যেসব পুরুষ ধর্ষণ করেছে, তাদের একজন সুনীতার তৃতীয় সন্তানের পিতা। রিশাব বলেন, ওই তিনটি সন্তান তার দ্বিতীয় স্বামীর কাছে ছিল। তিনি তাদেরকে তার কাছে রেখেছেন যাতে সুনীতা তার কাছে ফিরে যান।

উত্তর প্রদেশের হাপুরের এ ঘটনা পুরো ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সুনীতা আত্মহত্যা করতে গিয়ে নিজের গায়ে নিজে আগুন দিয়েছেন। অগ্নিদগ্ধ সুনীতাকে বাঁচাতে এরই মধ্যে দুটি হাসপাতাল পরিবর্তন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাকে নেয়া হয়েছে দিল্লিতে। বলা হয়েছে, তিনি স্থিতিশীল আছেন। তবে তার সঙ্কটজনক অবস্থা তার। রিশাব বলেন, সুনীতার এই বেদনা, ক্ষতের জন্য পুরোটাই দায়ী তার পিতা। তিনি অপেক্ষা করছেন সুনীতা সুস্থ হয়ে ফিরুন। তারপর তিনি তালাক দেবেন দ্বিতীয় স্বামীকে। এরপরেই তাকে বিয়ে করবেন তিনি। তবে এফআইএর বলা হয়েছে, সুনীতা ও রিশাব এরই মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সেই বিয়ে রেজিস্টার্ড হয়েছে এ বছর ২২ এপ্রিল।

Scroll to Top