বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়লেও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা থামেনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় বিমান হামলার দিন থেকে শুরু হওয়া সংঘাতময় পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। সোমবারেও (৪ ফেব্রুয়ারি) পাল্টাপাল্টি হামলা, হুমকি কিংবা প্রতিপক্ষের হামলা নস্যাতের দাবি তুলেছে দুই দেশই। এরইমধ্যে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে। কী হবে, যদি দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে?
বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত ও বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,সীমিত পর্যায়ে এমন একটি যুদ্ধ হলেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ২০০ কোটি মানুষ প্রাণ হারাবে। বিপন্ন হবে প্রকৃতি। হুমকিতে পড়বে খাদ্যচক্রসহ সমস্ত প্রাণ। ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ আর দীর্ঘতর পরিবেশগত বিপর্যায় ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে মানুষসহ আরসব প্রাণের অস্তিত্বকে।
অন্যসব দেশের মতো ভারত-পাকিস্তানও পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। সে কারণে তাদের পরমাণু অস্ত্রের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান হাজির করার সুযোগ নাই। তবে ধারণা করা হয়, এ থরনের অস্ত্র ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের হাতে বেশি পরিমাণে রয়েছে। অস্ত্র অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষার নামে গড়ে ওঠা অরাজনৈতিক দাতব্য সংগঠন আর্মড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন-এসিএ বলছে, ভারতের হাতে যেখানে ১৩৫টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে পাকিস্তানের হাতে রয়েছে ১৪৫টি। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের ১৩০-১৪০ টি আর পাকিস্তানের ১৪০-১৫০টি পরমাণু অস্ত্র আছে।
ভারতনিয়ন্ত্রতি কাশ্মিরে সে দেশে আধা-সামরিক বাহিনীর ওপর জইশ-ই মোহাম্মদের স্বঘোষিত আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হলে এই পর্যায়ের ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা শুরু হয়। হামলায় রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের মাটিতে বিমান হামলা চালায় ভারত। এরপর থেকেই দুই দেশের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে উঠে আসছে পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলা ও একে অন্যের হামলা প্রতিহত করার খবর। দুই দেশই একে অপরকে শাসাচ্ছে নিজেদের হাতে থাকা শতাধিক পারমাণবিক অস্ত্রের ইঙ্গিত সামনে এনে। তবে সত্যিই ভারত-পাকিস্তান এমন একটি যুদ্ধে জড়ালে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ। দুই দেশ ‘সীমিত আকারে’ এ ধরনের যুদ্ধে জড়ালেও তার প্রভাব শুধু তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষও এড়াতে পারবে না পরিবেশগত পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব। এমন যুদ্ধ হলে কেবল ধ্বংসই জয়ী হবে, হুমকির মুখে পড়বে প্রকৃতি, বিপন্ন হবে প্রাণের অস্তিত্ব।
ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো, রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালান রোবোক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রিক টার্কো ২০০৮ সালে একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে তারা বলেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তান যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় ফেলা বোমার মতো ১৫ কিলোটন ক্ষমতার ৫০টি করে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত করে, তাহলে তাতে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত হবে সাড়ে চার কোটি মানুষ। ওয়েন বি টুন ও তার সহযোগীদের ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতিতে যে খরা দেখে দেবে তার কারণে যুদ্ধের প্রথম পাঁচ বছর বিশ্বজুড়ে শস্য উৎপাদনের পরিমাণ কমবে প্রায় ২০ শতাংশ। তার পাঁচ বছর পরও শস্য উৎপাদনে হ্রাসের হার হবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ‘এশিয়া ট্রেডস দ্য নিউক্লিয়ার পাথ, আনওয়্যার দ্যাট সেলফ অ্যাস্যুর্ড ডেস্ট্রাকশন উড রেজাল্ট ফ্রম নিউক্লিয়ার ওয়ার’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনটিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, খরা ও খাদ্যাভাবের প্রভাবে প্রাণ হারাতে পারে। সেখানেই শেষ নয়। পারমাণবিক যুদ্ধ, পরিবেশগত বিপর্যয় ও খাদ্যাভাব থেকে সৃষ্ট নতুন যুদ্ধ আরও কোটি কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবে। বিজয়ী পক্ষকেও পুড়তে হবে ক্ষিধের আগুনে।
ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কথা উঠে এসেছে মাইকেল জে মিল ও তার সহযোগীদের ২০১৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে।
‘মাল্টিডিকেডাল গ্লোবাল কুলিং অ্যান্ড আনপ্রিসিডেন্টেড ওজনস লস ফলোয়িং এ রিজিওনাল নিউক্লিয়ার কনফ্লিক্ট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন বলছে, দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে ৫০ শহরে পারমাণবিক বোমা ফেললে ‘সীমিত’ ওই আক্রমণেই অন্তত ১০০টি অগ্নিঝড় তৈরি হবে। যে বিশাল পরিমাণ বাতাস অগ্নিঝড়ের আওতায় পড়বে, তাতে তৈরি হবে অতিকায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়বে বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে। এতে সূর্যালোক পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা পাবে। ফলে তীব্র মাত্রায় কমে যাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। এক হাজার বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া বরফ যুগের পর তখনই আবার অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রার মুখোমুখি হবে বিশ্ববাসীকে।
মেঘেরও ওপরে হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে বৃষ্টিপাতের কোনও সুযোগ নেই। ফলে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে সৃষ্ট ধোঁয়া বছরের পর বছর সেখানে থেকে যাবে। ফলে সূর্যালোক ঠিকমতো পৌঁছাবে না পৃথিবীতে। যাও বা পৌঁছাবে তাতে তাপমাত্রার ভারসাম্য আসবে না শীতল হয়ে যেতে থাকা সাগরের পানির ‘থার্মাল ইনার্শিয়ার’ কারণে। তাছাড়া বরফে পরিণত হওয়া পানির আগের চেয়ে বেশি সূর্যালোক প্রতিফলিত করতে থাকবে। সব মিলিয়ে পৃথিবীকে প্রায় ২৫ বছর ধরে নিম্ন তাপমাত্রার মধ্যে থাকতে হবে।
তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক যুদ্ধের প্রথম পাঁচ বছরে বিশ্বজুড়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে ছয় শতাংশ এবং তার পরবর্তী দশ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ চার দশমিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত কম থাকবে। এতে বহু স্থানে দেখা দেবে খরা। মধ্যপ্রাচ্য, উপমহাদেশ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পাবে ২০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। নিম্ন তাপমাত্রার পাশাপাশি খরার কারণেও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে চরম মাত্রায়।
পারমাণবিক যুদ্ধের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে চলতে থাকবে অন্য সমীকরণ। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে জমে থাকা ধোঁয়া দীর্ঘদিন ধরে সূর্যালোকের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকবে। সেখানকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই উত্তপ্ত ধোঁয়া বিক্রিয়া ঘটাবে ওজনের সঙ্গে। এতে ভেঙে পড়তে থাকবে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকিয়ে রাখা ওজন গ্যাসের স্তর। বিষুব রেখা অঞ্চলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে ওজন কমে যাবে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অতিবেগুনি রশ্মির প্রবেশ বাড়বে ৩০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। এই ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাবে স্বাস্থ্যগত জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষিও। তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং সেই সূত্রে খরার কারণে জলে-স্থলে প্রাণবৈচিত্রের যতটা না ক্ষতি হতো, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি ক্ষতি হবে।
পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করতে গিয়ে সেই ১৯৮০ ও ১৯৯০- এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দরুণ অতিবেগুনি রশ্মির প্রকোপ বাড়ায় সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। অথচ তাদের ওপর ভিত্তি করেই আদতে খাদ্যচক্র গড়ে উঠেছে। অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে মাছ মারা গেলে গোটা খাদ্যচক্রেই তার প্রভাব দৃশ্যমান হবে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জন্য সৃষ্টি হবে খাদ্য সংকট, অন্ধত্ব ও অস্তিত্বগত হুমকি।