বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে বেগবান করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে নারী শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল। পাশাপাশি হামলা, নিপীড়ন, আটকের শিকারও হয়েছেন নারীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম শুরু থেকেই এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। গত ২৮ জুলাই ভোররাতে বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি।
আন্দোলন-বিক্ষোভ ও ডিবি অফিসের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন শামসুন নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নুসরাত তাবাসসুম।
সাংবাদিক : আপনারা শুরু থেকে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর থেকে আপনারা বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিও যোগ করেন। মধ্যরাতে মেয়েদের হল থেকে হাজারো শিক্ষার্থী বের হয়ে বিক্ষোভ করেছিল। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল?
নুসরাত: গত ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির বাসভবনে স্মারকলিপি জমা দিয়ে ফেরার পর দেখলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু আপত্তিজনক শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার মধ্যে একটা ছিল রাজাকার। এই শব্দটা আসলে এতটাই গায়ে লেগে যায়। মানে বাংলাদেশে শুধু মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার, এই দুই গোষ্ঠীর মানুষ আছে? সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব কই? আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মায়নি, তাহলে আমি রাজাকারের সন্তান কীভাবে হলাম? উনার বক্তব্য আমাদের ক্ষুব্ধ করে। তখন আমরা খবর পাই যে হলপাড়া, মানে আমাদের পাঁচটা হল যে এরিয়াতে আছে- জসিমউদ্দিন, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়া হল, বিজয় একাত্তর, সূর্যসেন সেখানে ছেলেরা স্লোগান দিচ্ছে, সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করছে। তখন মেয়েদের হলগুলাতে ক্ষোভ উঠতে শুরু করে।
আমাদের প্রথম রিঅ্যাকশনটাই ছিল এই, অপমানটাতো আমাদের সবাইকে করল, এটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছেলেরা হলে মার খাবে আর আমরা মেয়েরা রাত ১০টার পরে হলের গেট বন্ধ বলে আমরা বসে থাকবো? তখন ১০টা ২০ বাজে, মাত্র হলের গেট বন্ধ হলো।
সে রাতে আমরা আসলে ভাবিনি যে হলের সব মেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে একত্রিত হয়ে বের হয়ে যাবে। মেয়েদের মত ছিল, যদি ছেলেদেরকে আটকে রাখে, তাহলে আমরা হলের তালা ভেঙে হলেও আমাদের ভাইদেরকে বের করে নিয়ে আসবো।
এরমধ্যে অন্যান্য হলের সমন্বয়কদের সাথে কথা হয়। জানতে পারি, সব হলের পরিস্থিতি এক। হল থেকে আমরা মেয়েরা যখন রাজুতে এসে জমা হচ্ছি, তখন সেখানে হাতে গোনা ১০টা ছেলেও ছিল না। ধীরে ধীরে মেয়েরা মিছিল নিয়ে ভিসি চত্ত্বরে যায়। তখন সাহস করে ছেলেরাও বের হয়ে আসে। পরে আমরা রাজুতে আসি। আমরা রাত ২টার দিকে আবার হলে চলে আসি। সে রাতেই মূলত পরবর্তী দিনের আন্দোলনটা আসলে কোন দিকে যাবে সেটা নির্ধারিত হয়ে যায়।
সাংবাদিক : এবং পরদিন কিন্তু মেয়েদের ওপর নির্মম হামলাও হয়েছে…
নুসরাত: চিরকালীন একটা স্ট্র্যাটেজি হলো, মেয়েরা মিছিলের সামনে থাকলে গায়ে হাত তোলার আগে সবাই একটু ভাবে, সে সন্ত্রাসী হোক আর যারাই হোক। কিন্তু তারা সেদিন টার্গেট করে মেয়েদের ওপরে হামলা করেছে। আমরা দুজন সামনে ছিলাম, সন্ত্রাসীরা ২০ গজ দূর থেকে, মেয়েদের দিকেই ইট পাটকেল ছোঁড়া শুরু করে। ওরা যদি চাইতো, তাহলে কিন্তু ছেলেদের মিছিল টার্গেট করতে পারতো। কিন্তু ওরা মেয়েদের মিছিলকেই টার্গেট করল। অনেক মেয়েকে নির্মমভাবে পিটিয়ে তারা আহত করেছে।
সাংবাদিক : ১৭ জুলাই যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হল ছাড়ার ঘোষণা এল এরপরে ছেলেদের হল দুপুর-বিকেলের মধ্যে খালি হলেও মেয়েরা সন্ধ্যা পর্যন্ত হল ছাড়েনি। সেদিনের আসলে কী ঘটেছিল?
নুসরাত: সেদিন ভিসি চত্ত্বর থেকে আমরা যখন কফিন মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাচ্ছিলাম তখন তিন দিক থেকে হামলার শিকার হয়েছি। সেদিনও আমি আহত হই, পরপর তিনদিন।
হলে ফিরে দেখি মেয়েরা সবাই বসে আছে টিভি রুমে। তারা বলেছে কেউ হল ছেড়ে যাবে না। পরে একটার পর একটা রিউমার আসতে শুরু করল। প্রথমে শুনলাম, যে ৬টার পরে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বিকেল থেকে রোকেয়া হলের সামনে সাউন্ড গ্রেনেড ফাটতে শুরু করলো। আমাদের হলের সামনে পুলিশ সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে রেডি। বলা হলো, রাত ৮টা বাজলে অন্ধকার হয়ে গেলে পুলিশ এসে একেকজনকে ধরে ধরে হল থেকে বের করে দিবে এবং হল প্রশাসন কোনো দায়িত্ব নেবে না।
১৬ জুলাই আমার হলে যতজন মেয়ে মিছিলে গিয়েছে প্রত্যেকেই কমবেশি আহত। এই আহত অবস্থায়, অসুস্থ অবস্থায়, মনভাঙা অবস্থায় আমরা দেখলাম যে কেউ আমাদের দায়িত্ব নিতে রাজি না। হল প্রশাসন বলল, রাত হলে পুলিশ দিয়ে বের করা হবে। তখন আমরাই বললাম যে ঠিক আছে, লয়্যালটি তো শুধু দেশের প্রতি না পরিবারের প্রতিও আছে। আপাতত আমরা হল ছাড়ি, হল ছাড়লেই যে আন্দোলন ছাড়ছি বিষয়টা তো এমন না।
আমাদের হলে বের হওয়ার সময় শেষ মেয়েটা ছিলাম আমি। প্রত্যেকটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছে।
সাংবাদিক : আপনাকে নিরাপত্তা হেফাজতের কথা বলে ডিবি অফিসে নেওয়া হলো। তার আগে আপনাদের ছয় সমন্বয়ককে নেওয়া হয়। সেখান থেকে আপনাদের একটি ভিডিও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, বিবৃতিসহ। ডিবি অফিসে আসলে কী হয়েছিল?
নুসরাত: আমাদের তো সত্যিকার অর্থে কালরাত্রি শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৭ তারিখ থেকেই। হল ছাড়ার পর আমি ছিলাম একদম মিরপুর এরিয়ার যে রণক্ষেত্র সেখানে। ছাদে উঠলে একেবারে পুরোটা দেখতে পেতাম। এটার মধ্যে থেকে কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নাই, আমি সারারাত জেগে থাকতাম। ভোরবেলায় একটু সময়ের জন্য ঘুমাতাম সকালে আবার একপাশ থেকে ফোন দেওয়া শুরু করতাম।
নাহিদ ভাই (নাহিদ ইসলাম) যেদিন গুম হয়ে গেল আমি সেই খবর পাই রাত ৩টায়। তারপর আমরা ফোনে ফোনে কাজ করছিলাম। প্রিন্ট মিডিয়াতে ৯ দফা পাঠানো হলো।
নাহিদ ভাই ফিরে আসলো, ইন্টারনেট ব্যবস্থা সাময়িক একটু সুবিধা পেলাম, আমরা ভাবলাম মনে হয় পরিস্থিতি একটু ভালো হচ্ছে। এর মধ্যে হুট করে নাহিদ ভাইদের যে আবার নিয়ে যাবে এই জিনিসটা একেবারেই কল্পনার বাইরে ছিল।
আমার বাসায় ডিবি এসেছে তিনটা দরজা ভেঙে। তখন রাত পৌনে ৫টা। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওয়ারেন্ট আছে কি না। তারা বলেছে, আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। আপনি যদি ওয়ারেন্ট ছাড়া না যান আমরা ওয়ারেন্ট আনিয়ে দিবো।
আমি একটা রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে বাড়িতে একটা কল দিতে চাই। তারা বলছে, যে আপনার বাড়িতে আমরা কল দিবো। তখন আমি বলেছিলাম তাহলে আর কল দিতে হবে না।
ডিবিতে যখন নিয়ে গেল তখনকার পরিস্থিতি আলাদা। টর্চার, ফিজিকাল-মেন্টাল টর্চার যেটা হয়েছে ৬দিন ব্যাপী সেটা নেহাত কম না। কিন্তু দেশের মানুষ যেটা সাফার করছিল সেটার তুলনায় কিছুই না।
ডিবিতে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, যদি খুব সংক্ষেপে বলি তারা বলেছে, ‘এতগুলো পুলিশ মরলো…ছাত্র মারা গেছে সন্ত্রাসীর হাতে কিন্তু পুলিশ মেরেছো তোমরা। যদি মামলা দিই তাহলে তোমরা কী করবা? মামলা তো একা খাবা না, পরিবারসহ খাবে…’ এই হচ্ছে হুমকি। এভাবেই আমাদের কাছ থেকে স্টেটমেন্ট ও ভিডিও বার্তা নেওয়া হয়।
বলা হয়েছিল ভিডিও বার্তা দেওয়ার পর আমাদের ছেড়ে দিবে। কিন্তু প্রত্যেক ঘণ্টায় আমরা প্রতারিত হয়েছি। রোববার আমাদেরকে বের করল না, বলা হলো সোমবার। সোমবারে হাইকোর্টে রিট হলো। তখন বলল, হাইকোর্টের ম্যাটার আর কিচ্ছু করা সম্ভব না। মঙ্গলবার হাইকোর্টে শুনানি হলো কিন্তু রায় হলো না। বুধবার একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকার কারণে আদালতই বসলো না এবং পরবর্তী শুনানি কবে হবে তারিখ দেওয়া হলো না। তখন আমরা আসলে চুরমার হয়ে যাই।
আদলত যদি আমাদের বের করতে না পারে, নির্বাহী পর্ষদ যদি আমাদের বের করতে না পারে তাহলে আমাদের বের হওয়ার আর উপায় নাই। ডিবির মধ্যে থেকে আমাদের প্রতিবাদ জানানোর কোনো ভাষা ছিল না। তখন জানতে পারি নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই, বাকের অনশন শুরু করেছে। মঙ্গলবার রাত থেকে আমিও অনশন শুরু করি। এটা ছিল নিরম্বু উপবাস, মানে আমরা পানি পর্যন্ত খাইনি।
বুধবার রাতে আমাদের বলা হয়, ‘আগামীকাল তো ছেড়ে দেয়া হবে, আপনারা কিছু খেয়ে নেন’। আমরা বলেছি, একেবারে পরিবারের সাথে বাইরে গিয়েই খাবো।
আমাদের যখন বের করা হয় তখনও সত্যি বলতে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে এই গাড়ি আমাদেরকে পরিবারসহ নিয়ে আসলেই কোথায় নামাবে।
আমাদের শিক্ষকরা নিজেদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জন্য ডিবিতে গিয়েছেন, রাস্তায় মানুষ আমাদের জন্য কথা বলেছে, মিডিয়া আমাদের হয়ে কথা বলেছে। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি বিশ্বাস করি জনতা যদি মাঠে না থাকতো, আমাদের হয়তো গুম করে দিতো।
জোর করে স্টেটমেন্ট ভিডিওটা করানো পর আমি প্রতি ঘণ্টা একবার করে আত্মহত্যার কথা ভেবেছি, যে দেশের মানুষ আমাকে বেঈমান ভাবার থেকে আমি এই মুখ নিয়ে আর বের না হই। এতটাই হতাশার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু দেশের মানুষ আমাদের ওপর ভরসা রেখেছে। ডিবিতে আমাদের নিয়ে যে নাটকটা করা হলো সেটা যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করেনি সেজন্য আমি দেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ।