একসময় আলু ছিল রপ্তানি পণ্য। এখন নিট আমদানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। আলুর পাশাপাশি আমদানি হচ্ছে গাজর, কাঁচা মরিচ, টমেটোও। কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়তে থাকায় বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ পদ্ধতি উন্নত করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও রপ্তানিকারকেরা।
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল বেশি। চাহিদার বাড়তি আলু রপ্তানি হতো বিশ্বের ১৬টি দেশে। তিন বছর আগে দুই লাখ টন আলু রপ্তানির রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। আলু রপ্তানির এসব গল্প ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। কারণ, চাহিদা মেটাতে প্রথমবারের মতো আলু আমদানি হয়েছে।
আলুর মতো কাঁচা মরিচ, টমেটো, গাজরসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য-সংকটের সময় আমদানি করতে হচ্ছে। এসব কৃষিপণ্যের আমদানি আগের তুলনায় বাড়ছে। এর বিপরীতে রপ্তানি কমছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু আমদানি হয়েছে ৯৮ হাজার ৭৩১ টন। একই সময়ে আলু রপ্তানি হয়েছে ১২ হাজার ৩৫২ টন। অর্থাৎ রপ্তানির প্রায় আট গুণ আলু আমদানি হয়েছে। রপ্তানি বাদ দিয়ে এ সময়ে নিট আমদানির পরিমাণ ৮৫ হাজার ৯১৩ টন। আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের তুলনা করলে দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আলু রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ ডলার। তার বিপরীতে আমদানিতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার।
একসময়ে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকা কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়তে থাকায় বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ পদ্ধতি উন্নত করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও রপ্তানিকারকেরা। তাদের মতে, বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নত করা গেলে আলুর মতো অনেক কৃষিপণ্য আমদানির দরকার হবে না। তাতে রপ্তানি যেমন করা যেত, তেমনি বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হতো।
রপ্তানি থেকে যেভাবে আমদানি পণ্য হলো
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫২ বছরে বাংলাদেশ কখনো চাহিদা মেটানোর জন্য আলু আমদানি করেনি। কারণ, এ সময়ে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল বেশি। এ সময়ে মূলত আলু উৎপাদনের জন্য আলুবীজ আমদানি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
তবে আলুর দাম বাড়তে থাকায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছরের ২ নভেম্বর প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আলু আমদানি শুরু হয়। হিলি, সোনামসজিদ, বুড়িমারী, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আলু আমদানি করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিদায়ী অর্থবছরে ৫ লাখ ৩০ হাজার টন আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে প্রায় ৯৮ হাজার টন আলু আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। প্রতি কেজি আলু আমদানিতে শুল্ককরসহ খরচ পড়ছে প্রায় ৩০ টাকা। খুচরা বাজারে এই আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা।
এমন সময়ে আলু আমদানি হচ্ছে যখন উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির প্রাথমিক হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। মাঠপর্যায় থেকে আলু বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ অপচয় হয়। সেই হিসাবে আলু পাওয়া যাবে প্রায় ৯৩ লাখ টন, যা চাহিদার প্রায় সমান। যদিও হিমাগার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদায়ী অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে কম।
আলুর মতো গাজর, টমেটো ও কাঁচা মরিচও আমদানি হচ্ছে। একসময় গাজর ও টমেটো সামান্য পরিমাণে আমদানি হতো, যখন দেশে মৌসুম থাকত না। এখন ধারাবাহিকভাবে আমদানি বাড়ছে। একই অবস্থা কাঁচা মরিচেও। দেশে দাম বেড়ে গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানির পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে। এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে তিনটি পণ্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার টন।
রপ্তানি কমছে
এফএওর হিসাবে, আলু রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে শুরু হয় ১৯৯৯ সাল থেকে। তখন খুবই সামান্য পরিমাণে আলু রপ্তানি হতো। ধীরে ধীরে রপ্তানি বাড়তে থাকে। আলু রপ্তানির সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ২ লাখ ৮ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১ লাখ টনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরও কমে ৩৪ হাজার টনে নেমে আসে। এবার আরও কমে প্রায় ১২ হাজার টনে নেমেছে। রপ্তানির গন্তব্যও কমছে। একসময় বিশ্বের ১৬টি দেশে রপ্তানি হতো বাংলাদেশের আলু, এখন সেখানে রপ্তানি গন্তব্য কমে ১১টিতে নেমেছে। চলতি বছর আলু রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
রপ্তানি কেন কমছে, জানতে চাইলে আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ফেরদৌসী বেগম বলেন, গত বছর কৃষক পর্যায়ে মাঠ থেকে আলু সংগ্রহ করে জাহাজে তুলে দেওয়া পর্যন্ত প্রতি কেজি ৩০ টাকার নিচে খরচ পড়ত। এখন তা ৪০-৪৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে রপ্তানিমূল্য বাড়ছে না। প্রণোদনা নিয়েও আলু রপ্তানিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এখন আলুর বাজারে যে অবস্থা, তাতে রপ্তানি সামনে আরও কমে আসবে।
আলু উৎপাদনে ঘাটতি নেই, দাবি করে তিনি আরও বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা গেলে বিদ্যমান উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানিও সম্ভব।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে ৪২৪ কোটি ডলারের আলু রপ্তানি হয়েছে। আলু রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ফ্রান্স। ২০২২ সালে আলু রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৬তম। রপ্তানি কমতে থাকায় সামনে ক্রমতালিকায় আরও পিছিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ।
আমদানিনির্ভরতা বাড়বে
উৎপাদন-ঘাটতির কারণে পেঁয়াজ, ডাল, রসুনের মতো কৃষিপণ্য আমদানিও নিয়মিতভাবে বাড়ছে। তাতে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ পণ্যও আমদানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এসব কৃষিপণ্য আমদানিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গ্লোবাল ভিলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুই বছর ধরে আলুর উৎপাদন খুব বাড়ছে না। আলুর ব্যবহার বাড়তে থাকায় উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ কমছে। উদ্বৃত্ত কমলে ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ পান। তাতে দামে অস্থিরতা হয়, যা এখন হচ্ছে। এ জন্য আলুর উদ্বৃত্ত বাড়াতে হলে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। আলুসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে না দেখিয়ে প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করা উচিত, যাতে সরকার উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারে।