আকারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ হলেও বৈদেশিক বিনিয়োগের জায়গা থেকে অবস্থান চতুর্থ। অর্থনীতির এ আকার ৫শ বিলিয়ন ডলারের মতো হলেও সে হারে দেশে বাড়েনি বিদেশি বিনিয়োগ।
জিডিপির সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগের তুলনা করলে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে। জিডিপির অনুপাতে দেশ দুটিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ যেখানে জিডিপির দেড় শতাংশের কম, সেখানে মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ ১২ শতাংশের বেশি, আর অর্থনৈতিক সংকট পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক বিনিয়োগও ২০ শতাংশের বেশি। যেখানে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা বিদেশি বিনিয়োগে এত এগিয়ে আছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন পারছে না — এটি বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এ সত্ত্বেও ২০২৩ সালের হিসাব বলছে, বিদেশি বিনিয়োগ ২০২২ সালের তুলনায় আরও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩.০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। এতে করে এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ১৬ শতাংশ।
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঙ্কটাডের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের পর ২০২২ সালে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও ২০২৩ সালে এসে কমে গেছে। মূলত যে উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটি এখন পর্যন্ত পূরণ না হওয়ায় বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক এ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু অবকাঠামোগতভাবে এখনও উন্নত হয়নি এগুলো। এ কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ পাচ্ছে না। অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশে শিল্পায়ন ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যে কাঙ্ক্ষিত অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) মাধ্যমে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ কাজ চলমান থাকবে বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যবসা সহজীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে আগামী ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭ পর্যন্ত অর্থবছরে ১১০টি সংস্কার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সহায়ক অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পদ সঞ্চালনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী অর্থবছরে ৬.৭৫ শতাংশে এবং মধ্যমেয়াদে ৭.২৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তবে শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল বাড়িয়ে বিদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা যাবে না উল্লেখ করে মাহফুজ কবির বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে বেশকিছু অর্থনৈতিক কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে উচ্চ সুদহার ও করের মতো বিষয়গুলো সমাধান করা না গেলে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো আসলেই কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে পদ্মা সেতুকে একটি মাইলফলক। কথাটি উল্লেখ করে সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বিডার নির্বাহী সদস্য ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফলে এখানে নতুন নতুন শিল্প গড়ে ওঠবে, যা জিডিপিতে অবদান রাখবে। এখানের কোন অঞ্চলে কোন ধরনের শিল্প এবং সেখানে শিল্প বিনিয়োগে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে এবং সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো প্রসঙ্গে সুবিধাজনক দিক উল্লেখ করে জানায়, ১০০ ভাগ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ডিএফআই) অথবা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে (ইপিজেড) যৌথ বিনিয়োগ অথবা এ এলাকার বাইরের বিনিয়োগের সব ধরনের সুযোগ বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য খোলা আছে।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে পাবলিক কোম্পানির শেয়ার কিনে তালিকাভুক্ত বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ; যেমন — বিদ্যুৎ খাত, তেল, গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধান, টেলিযোগাযোগ, বন্দর, সড়ক ও জনপথ এবং প্রত্যক্ষ ক্রয় অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় করা ও বেসরকারি ইপিজেড বিনিয়োগের সুযোগের কথা জানিয়েছে বিডা।
আগামী বছর থেকে বিডার ওয়ান স্টপ সেন্টার বিদেশিদের বিনিয়োগকে সহজ ও আকর্ষণীয় করতে সক্ষম হবে। এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস পূর্ণ গতিতে চালু হলে বিনিয়োগে গতি বাড়বে। এতে শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, দেশি বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়বে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনলাইনে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিজনেস অটোমেশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিডা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হয়। এ সার্ভিসের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা অনলাইনেই ১৫০ ধরনের সেবা নিতে পারবেন। এতে একদিকে সেবাগ্রহণ যেমন সহজ হবে, তেমনি সময় বেঁচে যাওয়ায় বিনিয়োগের গতি ত্বরান্বিত হবে বলে মতামত প্রকাশ করেন বক্তারা।
এখন পর্যন্ত ৪৮টি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বিডা। এর মধ্যে ৪১টি সংস্থা বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। ৪১টি সংস্থার মধ্যে ৩০টি সংস্থা নিজেদের সব ধরনের সেবা বিডার এ অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে নিয়ে থাকে এবং বাকি ১১টি সংস্থার সব সেবা অনলাইন পোর্টালের আওতাভুক্ত করতে বিডা কাজ করে যাচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।