রেললাইনের দুই পাশে উঁচু–নিচু সবুজ তৃণভূমি আর রংবেরঙের গাছপালা। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট লোকালয়। দেশের ট্রেনের দুলুনিতে আলাদা একটা রোমাঞ্চ আছে, বিদেশের মসৃণ রেলপথে সেটা বেশ মিস করছি। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ছোট ভাই ড. সায়েম আহমেদের সঙ্গে বালেকগামী ট্রেনে চড়ে বসেছি। আমাদের গন্তব্য অবশ্য লক লোমন্ড।
লক লোমন্ড শব্দটি স্কটল্যান্ডের গ্যালিক ভাষা থেকে এসেছে। এই ভাষায় লক অর্থ লেক বা হ্রদ আর লোমন্ড অর্থ সুউচ্চ পাহাড়। আয়তনের দিক থেকে যুক্তরাজ্যের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির হ্রদ এই লক লোমন্ড। স্কটল্যান্ডের প্রথম জাতীয় উদ্যান ট্রোসাকসের মধ্যে অবস্থিত লক লোমন্ড তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। আলোকচিত্রী ও ট্র্যাকারদের কাছে রীতিমতো স্বর্গ।
ঘণ্টাখানেক চলার পর এ পথের শেষ স্টেশন বালেকে এসে থামল ট্রেন। ছিমছাম ছোট্ট রেলস্টেশন। ঠিক যেন ওয়েস্টার্ন সিনেমায় দেখা কোনো রেলস্টেশন। ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, স্টেশন বিল্ডিং বলতে একতলা ছোট একটি ভবন। স্কটল্যান্ডের যত রেলস্টেশনে গিয়েছি, সবগুলোতেই বেশ বড় ও পুরোনো বিল্ডিং দেখেছি। ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে কয়েক মিনিট হেঁটে বালেক রোডে সুইনিজ ক্রুজ কোম্পানির কাউন্টার। সেখান থেকে ৯০ মিনিটের ক্রুজ ভ্রমণের জন্য ১৫ পাউন্ডের দুটি টিকিট কাটলাম। আধুনিক একটি ক্রুজ। আকারের কারণে ক্রুজ না বলে ফেরি বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। নিচতলায় রেস্তোরাঁ ও বসার জায়গা। সেখানে এক ভারতীয় বয়স্ক দম্পতির সঙ্গে দেখা। আমাদের দেখে জিজ্ঞাসা করল, আমরা ভারতীয় কি না। উত্তরে বললাম, না, আমরা বাংলাদেশি।
কুশলাদি বিনিময়ের পর ওপরের তলায় উন্মুক্ত ডেকে চলে গেলাম। সেখানে আগে থেকেই কয়েকজন বসে ছিলেন। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, একেবারে সামনের সিট ফাঁকা পড়ে আছে! সেই সিটে গিয়েই বসলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রুজ ছাড়ার ঘোষণা দিলেন ক্যাপ্টেন। ছোট নালার মতো লেভেন নদী ধরে ক্রুজ চলতে শুরু করল। দুই পাশে ইয়ট আর স্পিডবোট নোঙর করে রাখা। গ্রীষ্মকালে পর্যটক গমগম করে। এখন কিছুটা ঠান্ডা হওয়ায় পর্যটক কম।
লোমন্ড যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানেই মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু হাঁস। তাদের পাশ ঘেঁষে মনের আনন্দে কায়াকিং করছেন কয়েকজন পর্যটক। উত্তরে উঁচু ভূমি আর দক্ষিণে নিচু ভূমির মধ্যে লক লোমন্ডের অবস্থান। লম্বাটে সাইজের লক লোমন্ড লম্বায় প্রায় ৩৬ কিলোমিটার আর প্রস্থে ৮ কিলোমিটার।
টলটলে পানির গভীর লেকের ওপর দিয়ে আমাদের ক্রুজ এগিয়ে যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ জলভূমির ওপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাসের চোটে ঠান্ডাও খানিক বেশি লাগছে। ক্রুজের মাইকে লেকের ইতিহাস আর আশপাশের এলাকা নিয়ে বিস্তারিত জানানো হচ্ছে। স্কটিশ ইংলিশ উচ্চারণ খানিকটা আলাদা, তারপরও ইতিহাস জেনে খুব ভালো লাগছিল। হাতের ডান দিকে কিছুটা উঁচুতে সবুজ তৃণভূমির ঢালে বালেক ক্যাসেল, যাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে একটি পার্ক। যেখানে শিশুদের সময় কাটানোর অনেক সরঞ্জাম আছে। মাইকে বলল, সেখানে এখন কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।
হালকা ঢেউ কেটে লেকের মাঝ বরাবর চলছিল ক্রুজ, দুই ধারে গাছপালাঘেরা উঁচু পাহাড়িভূমি। পাদদেশে একেবারে লেকের কাছাকাছি হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট আর সুন্দর স্কটিশ গ্রাম। এই লেকের উজানে লাস নামের একটি গ্রাম আছে, গ্রীষ্মকালে সেই গ্রামে পর্যটকদের ভিড় লেগে যায়। লেকের পার হয়ে যায় পুরোদস্তুর ‘সমুদ্রসৈকত’। লক লোমন্ড আউটডোর অ্যাকটিভিটির স্বর্গরাজ্য। এখানে অনেক ক্যাম্পিং সাইট রয়েছে, পারমিট নিয়ে সেখানে রাত্রিযাপন করা যায়। ক্যারাভ্যান পার্কিংয়ের জন্যও রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
ইতিমধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়েছে ক্রুজ। ক্রুজের নাক বরাবর অত্যাশ্চর্য সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত। স্কটল্যান্ডে তিন হাজার ফুটের বড় পাহাড়কে বলে মুনরো। ট্র্যাকার বা হাইকারদের কাছে এখানকার ৩ হাজার ১৯৬ ফুট উচ্চতার বেন লোমন্ড মুনরো বেশ জনপ্রিয় গন্তব্য। ক্রুজের মাইকে এ রকম আরও অনেক তথ্য জানানো হচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে চলার পর ক্রুজটা একটি দ্বীপের কাছে এসে গতি কমাল। লেকে এ রকম ২২টি দ্বীপ রয়েছে, যার কয়েকটি আবার ব্যক্তিগত।
দ্বীপের আশপাশ খানিকটা ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল ক্রুজ। ততক্ষণে সূর্য অস্ত যেতে বসেছে, লেকের জলে অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণালি প্রতিফলন দেখতে দেখতে আমরা এগোতে থাকলাম।