teacher2

শিক্ষকের হাতে গড়া জাদুঘর!

কুমিল্লার নাজমুল আবেদীন পেশায় স্কুল শিক্ষক। নেশায় বিচিত্র ধরনের বিরল ও পুরনো জিনিসের সংগ্রাহক। ৩৮ বছর ধরে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। শখ ও ইতিহাস সংরক্ষণ চেতনা থেকে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি নিয়ে আজকের ফিচার

শিক্ষক নাজমুল আবেদীন নিজ উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর ধরে সংগ্রহ করছেন ঐতিহ্যবাহী ও দুর্লভ বিভিন্ন জিনিস। তাঁর সংগ্রহশালায় এরই মধ্যে পাঁচ শর বেশি নিদর্শন যুক্ত হয়েছে। মূলত শখের বশে অনেক দিন ধরে নানা নিদর্শন সংগ্রহ করার পর ২০১৫ সালে চিন্তা করেন একে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, যাতে জিনিসগুলো সাধারণ মানুষ দেখতে পারে। এই ভাবনা থেকেই তাঁর জাদুঘরের জন্ম।

শুরুতে নাজমুল আবেদীন কুমিল্লা শহরের মগবাড়ি চৌমুহনীর ভাড়া বাসায় নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমিল্লা জাদুঘর’। জাদুঘরটি ২০২১ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিল। সে বছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নগর উদ্যানের এক কোণে তাঁকে একটি ছোট আকৃতির ঘর তৈরি করে দেয়। বর্তমানে ১০ ও ২০ টাকা ফির বিনিময়ে জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে পারছে দর্শনার্থীরা।

নাজমুল আবেদীন জানিয়েছেন, টিকিটের আয়ের টাকা থেকে জাদুঘরটির দেখাশোনা এবং দর্শনার্থীদের গাইডের বেতনের খরচ মেটানো হয়। শিক্ষক নাজমুল আবেদীন চাঁদপুর গভর্নমেন্ট টেকনিক্যাল হাই স্কুলে কর্মরত। এর আগে শিক্ষকতা করেছেন কুমিল্লা জিলা স্কুল ও নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুলে।

একটি কক্ষের সীমিত পরিসরেই সংগৃহীত সব নিদর্শন প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছেন জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠাতা। জায়গার অভাবে অনেক কিছুই ভালোভাবে দেখাতে পারছেন না। নাজমুলের জাদুঘরের সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে একেবারে প্রথমদিককার টেলিভিশন সেট, শত বছরের পুরনো ইট, বিভিন্ন খনিজদ্রব্য, পাথর, সুতা কাটার চরকা, কাঁসা-পিতলের ডেগ, কয়েকটি পুরনো ‘সের’ ওজনের বাটখারা, পুরনো পাগলা ঘণ্টা (কারাগারে ব্যবহৃত), কৃষি সরঞ্জাম, ৩২ কেজি ওজনের পুরনো ফ্যান, হ্যাজাক বাতি, বিভিন্ন পশু-পাখির হাড় ও শিং, ১০০টি দেশের পুরনো মুদ্রা, পুরনো রেডিও, সাড়ে তিন শ বছরের পুরনো তালা ইত্যাদি। ঢেঁকি, পালকি ও গ্রামোফোনের মতো কিছু নিদর্শনও আছে, যেগুলো আমাদের জীবনে আর ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে।

নাজমুল আবেদীন জানান, স্কুলজীবন থেকেই পুরনো জিনিস সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তিনি। একসময় অনেকে একে পাগলামি বলত।

তবে এখন উৎসাহ দেয়। নিদর্শন সংগ্রহের জন্য এখন পর্যন্ত দেশের ৫০টির মতো জেলায় গিয়েছেন তিনি। গিয়েছেন দেশের বাইরেও। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন স্ত্রী ফারহানা মরিয়ম এবং ছেলে রূপক ও পুলক।

নাজমুল আবেদীন বলেন, ‘আমার মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্য এবং বিলুপ্ত ও দুর্লভ জিনিসগুলোকে যতটা পারি তুলে ধরা। অনেকে ভালোবেসে আমাকে পুরনো সামগ্রী দিয়ে যান। সেগুলোর গায়ে দাতার নাম লিখে প্রদর্শন করি। সিটি করপোরেশন থেকে জায়গা দেওয়ায় বর্তমানে সাধারণ মানুষ জাদুঘরটির নিদর্শনগুলো দেখতে পাচ্ছে। তবে জায়গাটি আরেকটু বড় হলে আমার সংগ্রহের সব জিনিস প্রদর্শন করা যেত।’

কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ‘আধুনিকতার নামে আমরা যখন ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনাশের পথে হাঁটছি, সেই সময় একজন সত্যিকারের ঐতিহ্য প্রেমিকের এই কাজটি আমাদের জন্য অনুকরণীয়। আশা করছি, তিনি কাজটি অব্যাহত রাখবেন। কুমিল্লাবাসীর উচিত, এই কাজে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা।’

জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক দর্শনার্থী বললেন, ‘এখন আপাতদৃষ্টিতে এসবের কোনো মূল্য না থাকলেও একসময় ছিল নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী। জীবনযাপনের অপরিহার্য অংশ। তাই জিনিসগুলো একটি সময়কে ধরে রেখেছে।’

কামরুল ইসলাম নামের আরেক দর্শনার্থী বলেন, ‘একটি দেশের ঐতিহ্য সে দেশের পরিচয় বহন করে। তাই ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই। সেই কাজটি করা হয়েছে এই জাদুঘরে।’

Scroll to Top