একসময় এতটা সহিষ্ণু ছিল না পৃথিবী। ঘোর অন্ধকার তথা অমানিশার আঁধারে, অসভ্য কলহে জর্জরিত ছিল বিশ্ব। মানবজাতি আত্মধ্বংসের দিকে ঝুঁকছিল। নিজেদের অপকর্মের কারণে টিকে থাকার সব অধিকার হারিয়েছিল। মানুষ তখন উন্মত্ত ও হিংস্র পশুর মতো আচরণ করছিল। সব সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, শালীনতা, নৈতিকতা এবং নাগরিক আইনকানুন যেন ভেসে গিয়েছিল বাতাসে। সে যুগকে বলা হতো বর্বরতার যুগ, জাহিলিয়াতের যুগ।
তখনই পৃথিবীতে ঘটে এক মহামানবের আবির্ভাব, যা খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা। সময়টা তখন খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক। ইতিহাসবিদ এইচ জি ওয়েলস বলেন, ‘এ সময় বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শনের যেন মরণ হয়েছিল।পৃথিবীতে মানুষ বলতে আর কিছু ছিল না।’ (আ শর্ট হিস্টোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড, ১২৪)
রবার্ট ব্রিফল্ট নামে আরেক ইতিহাসবিদ বলেন, ‘বর্বরতার এমন আঁধার ছিল, আদিম বন্যতার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ও বীভৎস।’ (দ্য মেকিং অব দ্য হিউম্যানিটি, ১৬৪)
আর বিখ্যাত লেখক জে এইচ ডেনিসন বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলার বালাই ছিল না। নব্য অধিকর্তারা ঐক্য ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে বিভাজন ও ধ্বংসের কাজে মগ্ন থাকেন।’ (ইমোশন অ্যাজ দ্য বেসিস অব সিভিলাইজেশন, ২৬৫)।
পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ এমন এক সময়ে আরবে এমন এক ব্যক্তির জন্ম দেন, যিনি মানবজাতিকে শুধু ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধার করেননি, তাঁকে এমন সুউচ্চ মহিমায় উন্নীত করেছেন, যা ইতিহাসবিদদের জ্ঞান এবং কবিদের কল্পনারও অতীত।
তার কীর্তি ও কৃতিত্ব উপস্থাপন করার মতো অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ আজ যদি না থাকতো, তাহলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো। তাই তিনি শুধু সমগ্র বিশ্বের জন্য রসুল ছিলেন না, ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। (আল কোরআন, ৪:৭৯ ও ২১:১০৭)
তিনি হজরত মুহাম্মদ (স.)। যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে। আরবে সে বছরকে বলা হতো হাতির বছর। সে বছর ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র মক্কা নগরীতে আমিনা বিনতে ওয়াহাবের গর্ভে বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। (নবী-জীবনের প্রসিদ্ধ বর্ণনাগুলো ১২ তারিখ বলা হয়েছে)
তবে মিসরের খ্যাতনামা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ পাশা ফালাকি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গাণিতিক সূত্র ধরে দীর্ঘ গবেষণার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন যে, তার জন্ম ‘হস্তির বছর’ রবিউল আউয়ালের ৯ তারিখ। ইংরেজি সাল অনুযায়ী ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ বা ২২ এপ্রিল। খ্যাতিমান সিরাত গবেষক সাইয়েদ সুলাইমান নদভি ও সালমান মানসুরপুরিও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। (তারিখে খাযরাম, ১/৬২; রহমাতুল লিল আলামিন, ১/৩ ও ৩৯)
সেদিন ছিল সোমবার। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, ‘রসুল (স.) সোমবার জন্মগ্রহণ করেন, সোমবার নবুয়ত লাভ করেন, সোমবার ইন্তেকাল করেন, সোমবার মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, সোমবার মদিনায় পৌঁছান, সোমবার হাজারে আসওয়াদ উত্তোলন করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর–২৫০৬)
মহানবী (স.)-এর আগমন ছিল যেন মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর দোয়ার ফসল। তিনি আরবের মক্কায় সন্তান ইসমাইলের সঙ্গে কাবা শরিফের নির্মাণ সম্পন্ন করে দোয়া করেছিলেন,
হে আমাদের রব, তাদের মধ্য থেকে একজন রসুল প্রেরণ করুন, যে তাদের নিকট আপনার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করবে; তাদের কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবে, আর তাদের পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (আল কোরআন ০২:১২৯)
মহানবী (স.) হলেন শেষ নবী। তিনি এসেছেন নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় ঈসা (আ.)-এর পর। ঈসা (আ.) নিজেও তার উম্মতকে মহানবীর (স.) শুভাগমন সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছেন, ‘আমি একজন রসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পর আসবেন, যার নাম আহমদ’ (আল কোরআন ৬১:৬)। পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবেও তার আগমনবার্তা দেয়া হয়েছে। (আল কোরআন ০৭:১৫৭)
মহানবী (স.) হলেন পৃথিবীর সে ফুল, যার আগমনে, যার খুশবুতে আজও সারা জাহান মাতোয়ারা হয়ে আছে; কিয়ামত পর্যন্তও থাকবে।