‘বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশে রেল চললে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে’ — বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এ বক্তব্য কি শুধুই রাজনৈতিক, নাকি সত্যিই শঙ্কার কিছু আছে? বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেন ইউরোপের উদাহরণ। আর বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এতে উদ্বেগের কিছু নেই।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলোর একটি এ রেল ট্রানজিট। ভারতের ট্রেন এতদিন বাংলাদেশের সীমান্তে এসে ইঞ্জিন পরিবর্তন করত এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের ইঞ্জিনে সেই ট্রেন ভারতে পৌঁছে দেয়া হতো। কিন্তু এখন ভারতের রেলগাড়ি বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে দেশটির পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।
এ ইস্যুটি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরে চলা আলোচনায় রোববার (৩০ জুন) যুক্ত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, সমঝোতার আড়ালে যেসব চুক্তি করা হয়েছে, তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে এবং কানেকটিভিটির নামে ভারতকে যে রেল ‘করিডর’ দেয়া হয়েছে তা দেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
বিএনপি মহাসচিবের এ প্রতিক্রিয়ার আগেই অবশ্য ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এ ইস্যুতে প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশকে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বলে সমালোচনা প্রসঙ্গও ছিল ওই প্রশ্নে।
জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইউরোপের উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, ‘ইউরোপে তো এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের কোনো বর্ডার নেই; তারা কি বিক্রি হয়ে গেছে? এতে বরং তাদের যোগাযোগ সুবিধা বেড়েছে; ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। প্রত্যেকটা দেশই তো স্বাধীন দেশ, তারা তো বিক্রি হয়নি। তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় কেন এটা বাধা হয়ে থাকবে?’
ভারতের সঙ্গে যে রেলগুলো বন্ধ ছিল সেগুলো আস্তে আস্তে খুলে দেয়া হচ্ছে এবং অর্থনীতিতে এটা বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে উল্লেখ করে সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন, ‘আমরা কি চারদিকে দরজা বন্ধ করে থাকব? ইউরোপের দিকে তাকান। সেখানে কি এক দেশ আরেক দেশের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে?’
ইউরোপকে আরও মজবুত করেছে কানেকটিভিটি
ঐতিহাসিকভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থেকেছে ইউরোপিয়ান দেশগুলো। এমনকি আধুনিক সময়ে এসেও দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধে ছারখার হয়েছে ইউরোপ। মহাদেশটির দুই পরাশক্তি ব্রিটেন এবং ফ্রান্স প্রায় দুশ বছর ধরে যুদ্ধ করার পরও সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে। প্যারিস থেকে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে লন্ডন যাচ্ছে দ্রুতগতির ট্রেন। এমনকি ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে গেলেও কানেক্টিভিটি ছিন্ন করেনি।
আর বর্তমানের ‘বর্ডারলেস’ ইউরোপ তো বাকি বিশ্বের জন্য উদাহরণ। যেখানে আইসল্যান্ড, লিচটেনস্টাইন, নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ডসহ ইইউভুক্ত ২৭টি দেশের নাগরিকরা কোনো বাধা ছাড়াই ভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে পরে। অর্থাৎ স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগর থেকে আটলান্টিক সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে অবস্থিত দেশগুলো বর্ডারের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকেও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইউরোপের ঘুরে দাঁড়ানো এবং আজকের পর্যায়ে আসার পেছনে এ অবাধ কানেক্টিভিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা আরও জোরালো হয়েছে।
ভারতের রেল চললে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কি হুমকিতে পড়বে
ভারতের এ রেল চুক্তিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো হুমকি হিসেবে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মতে বরং বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের কানেকটিভিটিতে যুক্ত হওয়া সময়োপযোগী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘শুধু বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলবে; কিন্তু আমাদের ট্রেনও ভারতের ভেতর দিয়ে নেপাল এবং ভুটান যাবে। এটা চুক্তিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে। কিন্তু এ কথাটা কেউ বলছে না।’
বিষয়টাকে একতরফা মনে করছেন না এ অধ্যাপক। তার মতে, যদি একতরফা হতোই তাহলে প্রশ্ন তোলা যেতো যে, বাংলাদেশ কী পাচ্ছে? কিন্তু তেমনটাতো হচ্ছে না!
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আরও বলেন, ‘যারা অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, তারা বলছেন যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের একটা বড় অর্থনৈতিক লাভ হবে। তবে প্রকৃতপক্ষে যতদিন বাস্তবায়ন না হচ্ছে, ততদিন আসলে বোঝা যাবে না, লাভটা কতটুকু।’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ জানান, ভারতের সঙ্গে কানেকটিভিটি তো এমনিতেই আছে। আকাশ এবং জলপথে আছে। নৌ কানেকটিভিটি ৬২ সালের যুদ্ধের পর কখনোই বন্ধ হয়নি; কেবল বন্ধ হয়েছিল স্থল।
এখানে আসলে একটা মানসিকতার বিষয় আছে বলে মনে করেন এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আমি যদি বলি দিব না, তাতে কি আমার কোনো লাভ হচ্ছে? বরং কানেকটিভিটির মাধ্যমে আশা করি পেশাদারিত্ব বাড়বে। আমাদের রেলওয়ে এবং স্টেশনগুলো বাড়বে। এক সময় বাস চলাচল করতো না। এখন সেটা হচ্ছে। তাতে কি বাংলাদেশের খুব একটা ক্ষতি হয়েছে? বরং অনেক দিক বিবেচনায় লাভ হয়েছে।’
ভবিষ্যতে এ অঞ্চলেও ইউরোপীয় মডেলের অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে আশা করেন এ অধ্যাপক। তার মতে বরং এ চুক্তি আঞ্চলিক সংযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের জন্য এখন বড় ব্যাপার হলো, নেপাল এবং ভুটানে যাওয়ার একটা পথ হলো। একইভাবে ওই দুই দেশেরও বাংলাদেশে আসার একটা পথ হলো। এর ফলে বাংলাদেশের মোংলা পোর্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে দাঁড়াবে।
‘নেপালের সঙ্গে চীনের একটা রেলওয়ে কানেকটিভিটি তৈরি হয়ে গেছে। সেটা হলে এই ট্রেনের মাধ্যমেই কিন্তু মানুষ বাংলাদেশ থেকে নেপাল হয়ে চীন যেতে পারবে। বৈশ্বিক কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে এখন রেলওয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। ফলে আগামীতে এই পথ ধরে মিয়ানমার, থাইল্যান্ডও চীনের সঙ্গে যোগাযোগের পথ তৈরি হবে বাংলাদেশর,’ বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
ভারতের সঙ্গে এ রেল চুক্তির যারা বিরোধী, তারা রাজনৈতিক কারণে এ রকম বক্তব্য দেন এবং এটাকে অতটা সিরিয়াসলি নেয়ার দরকার নেই বলে মনে করেন এ অধ্যাপক।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আতিকুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশের এখন দশ-বিশ বছর আগের চিন্তাধারা থাকলে চলবে না। ভারতের সঙ্গে রেল চুক্তিতে উদ্বেগের কিছু দেখেন না সাবেক এ কূটনীতিক। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা থাকতে হবে। একে অপরের সুবিধা-অসুবিধাগুলো উপলব্ধি করতে হবে।’
সাবেক এ কূটনীতিক বলেন, ‘আমি আশির দশকে ফ্রান্সে পড়াশুনা করেছি। তখনও ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতাম চোখের পলকে, যেন ঢাকা শহর থেকে ফরিদপুর গেলাম। এটা তিন চার দশক আগের কথা। অথচ আমরা সেই মান্ধাতার আমলে পড়ে আছি। আসলে পারস্পরিক সুবিধা-অসুবিধা দেখতে হবে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী — এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক যত ভালো থাকবে, উভয়ের জন্য সেটা তত লাভজনক এবং উন্নয়নের জন্য পরিপূরক।’
দুনিয়ায় এখন আর একঘরে হয়ে বসে থাকার দিন নেই বলে মনে করেন আতিকুর রহমান।