সন্তান ধারণের চেষ্টা করার পর টানা এক বছর সময়কাল যদি কোনো দম্পতি সফল না হন, তাহলে তাকে ইনফার্টাইল বা সন্তান ধারণে অক্ষম হিসাবে গণ্য করা হয়। বন্ধ্যত্ব নারী ও পুরুষ উভয়েই হতে পারে। সন্তান ধারণে অক্ষমতার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ই সমানভাবে দায়ী। সন্তান না হলে শুরুতেই শুধু স্ত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়, যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। বন্ধ্যত্বের নানা চিকিৎসা বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। এ চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর।
* নারীর বন্ধ্যত্বের কারণ
▶ পলিসিস্টিক ওভারি, যার মাধ্যমে একটা করে ওভাম আসার কথা, সেটা আসে না, প্রেগন্যান্সির জন্য যা জরুরি। জরায়ুর কিছু সমস্যা থাকে, যা জন্মগত হতে পারে আবার অসুখের কারণে হতে পারে।
▶ জন্মগত সমস্যার কারণে হয়তো ডিম আসছে না, টিউব ব্লক, জরায়ু যেটা আছে সেটা বাচ্চাদের মতো। আরও কিছু অসুখ আছে, যেমন-ওভারিয়ান চকলেট সিস্ট, অ্যান্ডোমেট্রিওসিস, থাইরয়েডের সমস্যার কারণেও বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
▶ যৌনবাহিত রোগের কারণে মেয়েদের প্রজনন অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
* পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ
একটা কারণ এজোস্পার্মিয়া, অর্থাৎ বীর্যের মধ্যে শুক্রাণু নেই। পুরুষের নালির কোথাও বাধার সৃষ্টি হয়েছে তাই শুক্রাণু মিলতে পারছে না। শুক্রাণু তৈরি হওয়ার যে স্থান অর্থাৎ অণ্ডকোষ, কোনো কারণে সেটি পুরুষের তৈরিই হয়নি। অনেক সময় শুক্রাণু থাকে কিন্তু পরিমাণে কম। আবার শুক্রাণুর পরিমাণ ঠিক আছে কিন্তু মান ঠিক নেই। যার ফলে সে ডিম ফার্টিলাইজ করতে পারে না।
এছাড়া টেস্টোস্টেরন হরমোনও ঠিক মতো ‘সিক্রেশন’ না হলে।
অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে, প্রজনন অঙ্গে কোনো ধরনের আঘাত, অস্ত্রোপচারের কারণে সৃষ্ট বাধা, প্রজনন অঙ্গে যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, কৈশোরকালে মাম্পস হলে। এমনকি মাথায় চুল গজানোর ওষুধও পুরুষের সন্তান ধারণের অক্ষমতার কারণ।
* চিকিৎসা
নারীর ডিম্বাণু বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ওষুধ, হরমোন, ইনজেকশন। ডিম্বাশয়ের নালি ও জরায়ুর সমস্যা দেখতে ল্যাপারস্কপি পদ্ধতি রয়েছে। সম্প্রতি স্বল্প পরিসরে চালু হয়েছে স্টেম সেল থেরাপি। সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতির দেহ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কৃত্রিম পরিবেশে তা নিষিক্ত করে আবার স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা বা ‘টেস্টটিউব বেবি’র ব্যবস্থা শুরু হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে।
পুরুষের জন্য ওষুধ দিয়ে শুক্রাণু বাড়ানো যেতে পারে। প্রতি মিলিতে ৪০ থেকে ১২০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকার কথা। যদি সংখ্যাটা ১০ মিলিয়নের নিচে নেমে যায়, তাহলে কৃত্রিম গর্ভধারণে যেতে হবে। যদি পুরোপুরি ‘অবস্ট্রাকশন’ হয়ে থাকে যে কারণে শুক্রাণু আসছে না, তাহলে দেখতে হবে অণ্ডকোষটা সক্রিয় আছে কিনা। অণ্ডকোষ সক্রিয় থাকলে সেখান থেকে সুঁই দিয়ে শুক্রাণু নিয়ে এসে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়া যায়। পৃথিবীর ভালো কেন্দ্রগুলোতেও অবস্ট্রাকশনের সার্জারি সফল হওয়ার হার মাত্র ২৫ শতাংশ। এটি ব্যয়বহুল, বিশ্বব্যাপী পুরুষের বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় এর সাফল্যের হার কম। নারী-পুরুষ দুজনের জন্যই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। এক সপ্তাহের ডোজেই এটি সেরে যায় না। তাই এক্ষেত্রে ধৈর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘টেস্টটিউব বেবি’র বেসরকারি পর্যায়ে খরচ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। কিন্তু এটি একবারে সফল নাও হতে পারে। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা অনেক কষ্টকর। তারপরও একটি সন্তানপ্রাপ্তির জন্য নিঃসন্তান দম্পতিরা বহুদূর পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে প্রস্তুত।
* জীবনযাত্রায় পরিবর্তন জরুরি
আমাদের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে সেটি স্বাস্থ্যসম্মত করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। নারীর খাদ্যাভ্যাস ঠিক করতে হবে। ক্যালরি বেশি করে খাওয়া কমাতে হবে। ঘরে রান্না খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। শরীরের স্বাভাবিক ওজন রক্ষা করতে হবে। জীবনাচারণ পরিবর্তন করতে হবে। দিনে ঘুমানো, রাতে জেগে থাকার মতো বদ অভ্যাস বদলাতে হবে। বয়স থাকতে বাচ্চা নিতে হবে।
লেখক : ডা. হাসনা হোসেন আঁখি (ফার্টিলিটি কনসালট্যান্ট ও গাইনোকলোজিস্ট, হার্টবিট ফার্টিলিটি ক্লিনিক, গ্রীণ রোড, ঢাকা)।