খুলনা নগরের ময়লাপোতা মোড়ে একটি ভ্যান ঘিরে মানুষের বেশ বড় জটলা। ভ্যানের ওপর পলিথিনে বিছানো কোরবানির মাংস। বিক্রেতা মো. হেলাল ক্রেতার চাহিদামতো মাংস ওজন করে দিচ্ছেন। তাঁর সহযোগীরা পাশে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক দিচ্ছেন ‘কিনলে আসেন, বেচলে আসেন।’
ওই এলাকায় হেলালের মতো আরও অনেকেই কোরবানির মাংস বিক্রি করছেন। নিয়মিত মাংসের বাজারের মতো ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখর পুরো এলাকা।
বটিয়াঘাটার হোগলাডাঙ্গার বাসিন্দা ইজিবাইক চালক মো. লাবলু ময়লাপোতা মোড়ে ইজিবাইক থামিয়ে ক্রেতাদের লাইনে শামিল হন। মিনিট দশেক লাইনে দাঁড়ানোর পর এক কেজি মাংস কিনতে পেরেছেন। ইজিবাইকের চালকের আসনের পাশে মাংস রাখতে রাখতে লাবলু বলেন, ‘কোরবানির গোশ। এক পিস হলেও খাতি হবে। তাই এখান থেকে নিছি। কসাইয়ের বসতি (স্থায়ী) যে দোকান, তারা নিজেরা জবাই দিয়ে বেচে। চাইলে সেখান থেকে কালও কিনে খাতি পারব; পরশু দিনও খাতি পারব। কিন্তু এই জিনিসটা বছরের একটি দিন। কোরবানি দিতি পারিনি। সকাল থেকে ভাড়া টানছি। গোশত কিনছি। মেয়ে-পোলারে নিয়ে খাওয়াব।’
ময়লাপোতা মোড়ের পাশাপাশি শেরেবাংলা রোডের আমতলা, হাজীবাড়ির মোড়, তেঁতুলতলা মোড়, নিরালা মোড়—সব মোড়েই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানির মাংস কিনছেন ও বিক্রি করছেন। এসব জায়গায় ৭৫০ টাকা কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে।
দিনের বেলা কোরবানি মাংস প্রস্তুতের কাজ করেছি। আগে যেসব বাড়িতে কোরবানির গোশতের কাজ করতাম, তারা কোরবানির গোশত দিয়ে দিত। সঙ্গে মাঝেমধ্যে বাজার করার খরচাও দিত। হাদিসে নাকি আছে, আমাদের গোশত দেওয়া যাবে না। এখন খালি টাকার ওপর দিয়ে চলছে। গোশত আর দিচ্ছে না। তাই গত দু-তিন বছর ঈদের দিন বিকেলে এই ব্যবসা করি। আর কেনা মাংস নিজেদের জন্যও কিছুটা রেখে দিই।
মো. শিমুল হাওলাদার, কোরবানির মাংস বিক্রেতা
আমতলা মোড়ে মাংস কেনাবেচা করছিলেন মো. মনির হোসেন। তিনি নগরের সন্ধ্যা বাজার এলাকায় মাছ বিক্রি করেন। ঈদের সময় মাছের বাজার দু-তিন দিন বন্ধ থাকে, তাই কয়েক বছর ধরেই মনির ঈদুল আজহার দিন এই ব্যবসা করেন। আজ সোমবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তিনি ২১ কেজি মাংস কিনে পুরোটাই বিক্রি করতে পেরেছেন।
মনির বলেন, ‘কিনছি ৭০০ টাকা, বেচছি ৭৫০। মাছের বাজার দু-তিন দিন বন্ধ থাকবে। আমাদের তো চলতে হবে। এই মাংস বিক্রি করলে বাজারখরচাটা তো উঠবে। এই গোশত কেনার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। যাঁরা কোরবানি দিতে পারেন না, কোরবানির এই গোশত তাঁরা শখ করে খান। তা ছাড়া এটা একবারে টাটকা এবং এঁড়ে গরুর গোশত। সন্ধ্যার দিকে ৮০০ টাকা বললেও নিয়ে নেবে।’
সেখানকার একজন ক্রেতা সাবিনা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখন কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আবার বাইরে গিয়ে চেয়ে খাওয়া আমাদের দিয়ে হবে না। আত্মীয়স্বজনদের বেশির ভাগ গ্রামে থাকেন। শহরে যেসব স্বজন থাকেন, তাঁদেরও একই রকম অবস্থা। তাই এখান থেকে কিনেই কোরবানির গোশতের স্বাদ নিতে হচ্ছে।’
নিরালা হাজী বাড়ি মোড়ে মাংস কেনাবেচা করছিলেন মো. শিমুল হাওলাদার। তিনি ইট-বালুর গোলায় কাজ করেন। আজ ঈদুল আজহার দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে পশু জবাই ও মাংস প্রস্তুতের কাজ করেছেন দল বেঁধে। ভাগে পেয়েছেন ২ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, ‘দিনের বেলা কোরবানি মাংস প্রস্তুতের কাজ করেছি। আগে যেসব বাড়িতে কোরবানির গোশতের কাজ করতাম, তারা কোরবানির গোশত দিয়ে দিত। সঙ্গে মাঝেমধ্যে বাজার করার খরচাও দিত। হাদিসে নাকি আছে, আমাদের গোশত দেওয়া যাবে না। এখন খালি টাকার ওপর দিয়ে চলছে। গোশত আর দিচ্ছে না। তাই গত দু-তিন বছর ঈদের দিন বিকেলে এই ব্যবসা করি। আর কেনা মাংস নিজেদের জন্যও কিছুটা রেখে দিই।’
কাদের কাছ থেকে কীভাবে এসব মাংস কিনছেন জানতে চাইলে শিমুল হাওলাদার বলেন, ‘কোরবানি শেষে গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে মাংস বিলিয়ে দেন অনেকেই। গরিব-অসহায় মানুষ সকাল থেকে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে যেসব মাংস সংগ্রহ করেন, সেগুলো তাঁরা আমাদের কাছে বিক্রি করছেন। তাঁদের কাছ থেকে কিনছি ৭০০ টাকা কেজি। আবার একটু বেশি দিয়েও কিনছি। সলিড গোশ হলে কিছুটা বাড়িয়ে দিচ্ছি। তেল-চর্বি-হাড্ডি বেশি হলে একটু কমিয়ে দিচ্ছি। মানে মান অনুযায়ী দাম। তবে গড়ে সেটা ৭০০ টাকা পড়ে যাচ্ছে।’
শিমুলের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে একটা মাংসের ব্যাগ নিয়ে হাজির হন এক নারী। প্রথমে ওজন করে দেখেন ৩ কেজি ৮০০ গ্রাম হয়েছে। সেখান থেকে ১ কেজি ৮০০ গ্রাম তিনি বিক্রি করে দেন। বাকি দুই কেজি নিজের ব্যাগে রাখেন। ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোদ গরমের মধ্যি সারা দিনে গোশ যা পাইছি, তার তে কিছু বেচি দিলাম। বাড়িতে মেয়ে-জামাই আইছে। তাগো জন্যি খানিকটা নি যাচ্ছি। বেচার টাকা থেইকি বাজারসদাই, মসলাপাতি কেনব। রাতি একসঙ্গে বুসে দুটো খাব।’