Economy

নতুন বাজেটে কিডনি চিকিৎসার ব্যয় আরো বাড়বে

► চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক ১% থেকে বাড়িয়ে ১০% করা হতে পারে ► অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহৃত সব ধরনের যন্ত্র আমদানিতে শুল্ক বাড়ছে

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নানা খাতে অতিরিক্ত কর আরোপে বাদ যাচ্ছে না স্বাস্থ্য খাতও। আগামী অর্থবছরে রেফারেল হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত দুই শতাধিক চিকিৎসা যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। কিডনি রোগীর ডায়ালিসিসের জন্য আমদানীকৃত উপকরণে যুক্ত হচ্ছে শুল্কের বোঝা। এতে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় খরচ আরো বাড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। এর মধ্যে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় এই রোগীদের ৮০ শতাংশই তাদের চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে পারছে না। বিশেষ করে ডায়ালিসিসের অনেক রোগী হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে ডায়ালিসিস উপকরণের শুল্ক বাড়লে চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়বে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এসব চিকিৎসাসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি বর্তমানে অন্যান্য শুল্ক ও ভ্যাট থেকে মুক্ত।

জটিল অস্ত্রোপচারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ও সরঞ্জাম, আইসিইউ ও লাইফ সাপোর্টে ব্যবহারের যন্ত্রপাতি, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে অজ্ঞান করার সরঞ্জামসহ সব ধরনের যন্ত্র আমদানিতে শুল্ক বাড়ছে। এতে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা আরো ব্যয়বহুল হবে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই পদক্ষেপ গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবা ব্যয় আরো বাড়িয়ে দেবে, বিশেষ করে যারা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার বদলে দেশেই চিকিৎসাসেবা নেয়।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশে চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে। সামর্থ্যবানরা দেশে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার পরিবর্তে বিদেশে চিকিৎসাসেবা নেবে।

ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়বে। বর্তমানে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নেয়। এই সংখ্যা ১০ লাখ হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, শুল্ক বাড়ালে চিকিৎসার খরচও বাড়বে। ল্যাবএইড হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র ১৫০ ডলারে একটি এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করা যায়, যেখানে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে একই পরীক্ষার খরচ প্রায় ৪৫০ ডলার। সরকারের উচিত অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর পরিবর্তে বিলাসবহুল পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্ত বলেন, রেফারেল হাসপাতালগুলো বর্তমানে চিকিৎসাসামগ্রী কম শুল্কে আমদানি করলেও সেবার জন্য যথেষ্ট চার্জ করে। চিকিৎসার ব্যয় না বাড়িয়ে সরকার এই খাত থেকে আরো বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছে।

হাসপাতালে ৫ শতাংশ দরিদ্র রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার শর্তে ২০০৫ সালে শূন্য শুল্কের সুবিধাটি চালু হয়েছিল। পরে বেশির ভাগ হাসপাতাল বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের শর্ত পূরণ না করায় ২০১৭ অর্থবছরে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে সরকার।

রেফারেল হাসপাতাল হতে গেলে আরো কিছু শর্ত পালন করতে হয়। সেগুলো হলো নূ্যূনতম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মনোডিসিপ্লিনারি বা ন্যূনতম ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতাও থাকতে হবে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকতে হবে এবং সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।

বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো বিদেশ থেকে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে রেফারেল হাসপাতাল সুবিধা ভোগ করছে। দেশের প্রধান রেফারেল হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে বারডেম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, এভারকেয়ার হাসপাতাল, জয়নুল হক সিকদার মহিলা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইব্রাহিম ইকবাল মেমোরিয়াল হাসপাতাল, জালালাবাদ রাজিব-রাবেয়া মেডিক্যাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, সালাউদ্দিন বিশেষায়িত হাসপাতাল, আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল ও ল্যাবএইড বিশেষায়িত হাসপাতাল।

এ ছাড়া গ্রিন লাইফ হসপিটাল, এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, সুমনা হসপিটাল, মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ, ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ, কেয়ার স্পেশালাইজড হসপিটাল, এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও আসগর আলী হাসপাতালও এই তালিকায় রয়েছে।

হাসপাতালসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণ জ্বর-ঠাণ্ডা থেকে শুরু করে জটিল অসুখ, অপারেশন আর জীবন বাঁচানোর জরুরি চিকিৎসা, ডাক্তারের ফি, প্যাথলজির পরীক্ষা, ওষুধপত্রের দাম—সব কিছুর খরচ ঊর্ধ্বমুখী। চিকিৎসা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তা আছে শুধু কাগজেই। বাস্তবতা ভিন্ন। তাই সরকারকে যেকোনো সিদ্ধান্ত আরো বিচার-বিশ্লেষণ করে নেওয়া উচিত।

Scroll to Top