বিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কম্পিউটার সায়েন্স ও সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণের ফলে দেশে কম্পিউটার সাক্ষর জনশক্তি এবং কম্পিউটার প্রকৌশলীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্পিউটার পরিচালনায় সক্ষম এই জনশক্তি বৃদ্ধির ফলে দেশে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জনশক্তির একটি অংশ অনলাইনে বিভিন্ন দেশের তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু এই কর্মশক্তিকে বৈজ্ঞানিক সহায়তা দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলীর অভাব রয়েছে।
সে জন্য দেশে সফটওয়্যার তৈরিতে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশল সেবাদানকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে তথ্য-প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিকাশমান নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের প্রবেশ বিলম্বিত হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলী সৃষ্টিতে সফটওয়্যার প্রকৌশলে মৌলিক গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশল বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞানের শাখাগুলো হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান (computational linguistics) ও পরিজ্ঞানমূলক ভাষা বিজ্ঞান।
অর্থাৎ কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশল চর্চায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা যেমন প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে ভাষাবিজ্ঞান গবেষণাও প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদের পাঠ্যক্রমে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। সে জন্য কম্পিউটার প্রকৌশলে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তাঁদের গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে কোনো ব্যুৎপত্তি অর্জন হয় না। কাজেই কম্পিউটার প্রকৌশলীদের মধ্যে যাঁরা সফটওয়্যার প্রকৌশল নিয়ে চর্চা করছেন, তাঁদের গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের ব্যুৎপত্তিগত ঘাটতি মোকাবেলায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষাবিজ্ঞানকে আয়ত্ত করে নিতে হয়।
প্রথাগতভাবে যেসব কম্পিউটার প্রকৌশলী কম্পিউটারের সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাকৃতিক মানবভাষা প্রক্রিয়াকরণের কাজ করতেন, তাঁরাই মূলত গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের স্বপ্নদ্রষ্টা। কাজেই মানবভাষা প্রক্রিয়াকরণের ভিত্তির ওপরই গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এটি গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান নামে স্বতন্ত্র একটি বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক দুটি দিকই আছে। তাত্ত্বিক গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান তাত্ত্বিক ভাষা বিজ্ঞান এবং বোধবিজ্ঞানের আঙ্গিকে মানবভাষা প্রক্রিয়াকরণের সূত্র আবিষ্কার করা হয়।
অন্যদিকে ব্যাবহারিক গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে সাবলীল মানবভাষার পরিসংখ্যানগত বা গাণিতিক সূত্র ভিত্তিক মডেল নির্মাণ করা হয়ে থাকে।
এভাবে গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান আন্তঃশাস্ত্রীয় বিজ্ঞান হওয়ায় এই বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জনে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক—এই দুই দিকেই পারদর্শিতা অর্জন করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদের পাঠ্যক্রমে এই বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ কারণে মানবভাষা প্রক্রিয়াকরণের পরিসংখ্যানগত বা গাণিতিক সূত্র ভিত্তিক মডেল নির্মাণে কম্পিউটার প্রকৌশলীদের ব্যাবহারিক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পারদর্শিতায় পিছিয়ে রয়েছেন।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কম্পিউটার প্রকৌশলীরা এগিয়ে। গত এক দশক সে দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) নামক প্রকৌশল ইনস্টিটিউটগুলোতে ভাষাবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন ও গবেষণা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইআইটিগুলোতে একটির পর একটি ভাষাবিজ্ঞানের শাস্ত্রীয় সেমিনার ও সম্মেলনের আয়োজন চলছে। এমনকি সর্বভারতীয় ভাষাবিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠান লিঙ্গুয়িস্টিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়াও আইআইটিগুলোতে শাস্ত্রীয় সম্মেলনের আয়োজন করছে।
এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমৃদ্ধ হতে গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি অর্জন করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জনে তত্ত্বীয় ভাষা বিজ্ঞান পাঠ জরুরি। তত্ত্বীয় ভাষা বিজ্ঞান আবার ধ্বনি তত্ত্ব, রূপমূল তত্ত্ব, বাক্যবিন্যাস তত্ত্ব ও বাগর্থ তত্ত্ব ইত্যাদি ধারায় বিভক্ত। দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদ রয়েছে, সেসব অনুষদের পাঠ্যক্রমে তত্ত্বীয় ভাষা বিজ্ঞান ও গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থী ও গবেষকরা এই বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার সুযোগ পাবেন। তাঁরা গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারবেন এবং তাঁরা সেই পারদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলের অন্যতম শাখা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ব্যুৎপত্তি অর্জনে সক্ষম হবেন।
এই প্রক্রিয়ায় দেশে সামগ্রিকভাবে সক্ষম সফটওয়্যার প্রকৌশল চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এই পরিবেশে দেশে সক্ষম কম্পিউটার প্রকৌশলীর সংখ্যা বৃিদ্ধ পাবে। ফলে কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলে বিদেশনির্ভরতা হ্রাস পাবে। এভাবে দেশ সফটওয়্যার প্রকৌশল এবং কম্পিউটার প্রকৌশলের শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হলে দেশের কম্পিউটার প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হবে। তাঁরা একদিকে যেমন তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারবেন, অন্যদিকে তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অতি প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবেন।
কাজেই দেশে কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রকৌশলী তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদগুলোর পাঠ্যক্রমে তত্ত্বীয় ভাষা বিজ্ঞান ও গণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান বিষয়বস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক।