upozila

উপাচার্যের দুই ছেলে ও ভাগনির চাকরি, ভাড়ায় চলে স্ত্রীর গাড়ি

ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়ার দুই ছেলে। চার মাস আগে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পেয়েছেন তাঁর ছোট ছেলে। একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা পদে উপাচার্যের নিজ জেলা নরসিংদীর অন্তত সাতজনের চাকরি হয়েছে। উপাচার্য তাঁর স্ত্রীর একটি গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পে এক বছর ভাড়া খাটিয়েছেন।

এ ছাড়া অভিজ্ঞতা না থাকা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ১২ কোটি টাকা খরচ করে গ্রিনহাউস নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এতে অনিয়ম হলেও ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং তাদের বিল পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। করোনাকালে যখন সরকার ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে, সে সময় বাসভবনে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ৩০ লাখ টাকা খরচ করেছেন উপাচার্য। এ ছাড়া দুই বছর আগে কৃষির গুচ্ছ পরীক্ষা আয়োজনে আয়-ব্যয়ের হিসাব এখনো কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ে জমা পড়েনি। অনুসন্ধান ও নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বলছেন, উপাচার্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে একের পর এক অনিয়ম করে যাচ্ছেন। তাতে মেধাবী ও ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাননি। উপাচার্যের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তুলনামূলক কম সিজিপিএধারী প্রার্থীরা নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্য নিজের জেলাকে প্রাধান্য দেওয়ায় অন্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। তবে উপাচার্য শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যরাই নিয়োগ পেয়েছেন। সততার সঙ্গে তিনি শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন।

উপাচার্যপুত্রের চাকরি, নরসিংদীর সাত শিক্ষক
অধ্যাপক মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর। এর আগে ২০১২ সাল থেকে তিনি সহ-উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১০ সালে তাঁর বড় ছেলে আসাদুল্লাহ হিল কাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী খামার তত্ত্বাবধায়ক পদে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ডেপুটি চিফ ফার্ম সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। অধ্যাপক শহীদুর রশীদ ওই সময় ছেলে ছাড়াও ২০১৩ সালে ভাগনি সাজিয়া আফরিনকে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেন। বর্তমানে তিনি প্যাথলজি বিভাগের সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

বাসভবনে সংস্কারের নামে ৩০ লাখ টাকা খরচ নিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এ টাকা আমি খরচ করিনি। আমার পকেটে আসেনি। এটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খরচ হয়েছে।’

উপাচার্যের ছোট ছেলে হামিম আল রশীদ গত ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পান। তিনি এখন মেরিন, ফিশারিজ অ্যান্ড ওশানোলজি বিভাগে কর্মরত। উপাচার্য শহীদুর রশীদের আমলে শিক্ষক পদে সবচেয়ে বড় নিয়োগ হয় ডিসেম্বরে। তখন প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে ৫৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে তাঁর নিজ জেলা নরসিংদী থেকে নিয়োগ পান সাতজন।

তারা হলেন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগে নাজমুস সাকিব, অ্যাগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাকোয়াটিক এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে জাহিদ হাসান, কৃষি বনায়ন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে জান্নাতুন নেছা, অ্যাগ্রোনমি বিভাগে মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, মেরিন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগে রাশেদুল হক এবং জেনেটিকস অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে হোসনে আরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য শহীদুর বলেন, ‘আগের ভিসির সময়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নরসিংদী থেকে একজনও নিয়োগ পায়নি। এবার তারা আবেদন করেছে। তারা চাকরি পাওয়ার যোগ্য। তাই তাদের চাকরি দিয়েছি।’ নিজের ছেলের চাকরির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যদের মতো নিয়ম মেনে আমার ছেলে আবেদন করেছে। সে চাকরি পাওয়ার যোগ্য। সব শর্ত অনুসরণ করে তার চাকরি হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের স্বজনপ্রীতি অগ্রহণযোগ্য। নিজ সন্তানকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া প্রশ্নবিদ্ধ।

ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)
তুলনামূলক ভালো ফল নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের শিক্ষার্থী সায়মা বিলা সেতু। তিনি বলেছেন, স্নাতকে সিজিপিএ–৪–এর মধ্যে ৩ দশমিক ৯৭ এবং স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ–৪–এ ৪ পেলেও তিনি নির্বাচিত হননি। সেখানে স্নাতকে ৩ দশমিক ৭ সিজিপিএ নিয়ে প্রভাষক পদে চাকরি পেয়েছেন আরেকজন। সায়মা সেতু বলেন, ‘আমার তদবির ছিল না বলে চাকরি হয়নি।’

কৃষিতত্ত্ব বিভাগে আবেদন করা প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়েও চাকরি হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নাজনীন আহমেদ। এ বিভাগে চাকরি পান নরসিংদীর বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। তিনি দাবি করেছেন, নিজের যোগ্যতাবলেই চাকরি পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এই নিয়োগ এবং দরপত্র ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউজিসি গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। এতে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য কমিশনে পাঠাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগসংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান নিয়োগ কার্যক্রমের কোনো প্রস্তাব সিন্ডিকেটে উপস্থাপন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

ইউজিসির পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) মোহাম্মদ জামিনুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রমাণসহ লিখিত বক্তব্য পাওয়ার পর ইউজিসির সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়ে দেওয়া হবে।

ভাড়ায় উপাচার্যের স্ত্রীর গাড়ি

‘শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন (২য় পর্যায়–১ম সংশোধিত)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পে নিজের স্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়ায় খাটিয়েছেন উপাচার্য। নথিতে দেখা গেছে, মেসার্স এমএস ভার্সন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাড়িটির ভাড়া বাবদ মাসে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের জুন থেকে এক বছর গাড়িটি ওই প্রকল্পে ভাড়ায় খাটানো হয়েছে।

ঢাকা মেট্রো গ-৩৭-৪৮১৬ নম্বরের গাড়িটি উপাচার্যের স্ত্রী জিন্নাতুন নাহারের নামে নিবন্ধন করা ছিল। গত বছর জিন্নাতুন নাহার মারা যান। পরে গাড়িটি উপাচার্য শহীদুর রশীদ ভূঁইয়ার নামে নিবন্ধিত হয়েছে বলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

এ বিষয়ে উপাচার্য ‘গাড়িটা আমরা ওই কোম্পানিকে দিই। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়ি সরবরাহ করতে আবেদন করে। এখানে উপাচার্য হিসেবে আমার কী করার আছে? এখানে খারাপ কিছু দেখি না।’ আর এম এস ভার্সনের স্বত্বাধিকারী মনিরুজ্জামান বলেন, তাঁর রেন্ট এ কারের ব্যবসা নেই। তিনি মূলত আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন।

Scroll to Top