মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে না রাখতে হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বুধবার এ আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রিটকারী পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
পরে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে। উভয়ক্ষকে শুনানি করে রায়ের কার্যকারিতা আগামী ২৫ অগাস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপিল দায়ের করতে বলেছে।”
মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে গত সোমবার রায় ঘোষণা করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
ওই রায় স্থগিত চেয়ে মঙ্গলবার আপিল বিভাগে যায় রাষ্ট্রপক্ষ।
হাই কোর্টে রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আপিল, রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার ধাপগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়।
সেইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে এখন সারা দেশে যত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে তাদের দুই বছরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সাধারণ সেলে সরিয়ে নিতে বলা হয়।
তবে বিশেষ কারণে (স্বাস্থ্যগত কারণ, সংক্রামক রোগ ইত্যাদি) কোনো ব্যক্তিকে নির্জন কক্ষে রাখতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ; সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির উপস্থিতিতে শুনানি হতে হবে।
কনডেম সেলে থাকা তিন আসামিকে নিয়ে ২০২১ সালের ১৮ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন যুক্ত করে ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর এ রিট আবেদন করেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
সে সময় প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করেছিল হাই কোর্ট। মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে বন্দি রাখা কেন বেআইনি ঘোষণা হবে না এবং কেন জেলকোডের ৯৮০ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সেখানে।
একইসঙ্গে কনডেম সেলে থাকা বন্দিদের বিষয়ে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
সেই রুলের ওপর শুনানি শেষে সোমবার রায় ঘোষণা করে হাই কোর্ট।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যর্বিধিতে কোনো আসামিকে নির্জন কারাবাসে রাখা যাবে, তবে তা ৩০ দিনের বেশি নয়। এর মধ্যে টানা ১৪ দিন এবং মাসে ৭ দিনের বেশি নয়। কাজেই মৃত্যুদণ্ডের রায়ে পর কনডেম সেলে রাখা হলে তা দুইবার সাজার সমতুল্য।
রায়ের নির্দেশনায় আদালত বলেছে, সরকার কারাবিধি সংস্কারের যে কাজ করছে, সেখানে যেন এই রায় ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন থাকে।
যদি কেউ তথ্য অধিকার আইনে কারাবন্দি সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে চায়, তাহলে সে তথ্য দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয় রায়ে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের জামিন আবেদন নিয়েও আদালত নির্দেশনা দিয়েছে।
বর্তমান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের জামিন আবেদন যে হাই কোর্টে গ্রহণ করা হয় না, সে কথা তুলে ধরে আদালত আপিল চলমান থাকা অবস্থায় তাদেরও অন্য আসামিদের (যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়নি) মত জামিন আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
পর্যবেক্ষেণে আরও বলা হয়, হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়। এরপর আপিল হলে লেগে যায় আরও অন্তত আট বছর। আপিলের রিভিউ আবেদন হলে তা নিষ্পত্তিতে লাগে আরও দুই বছরের মত। অর্থাৎ চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য ১৫-২০ বছর লেগে যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় এই পুরো সময়টাই আসমিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেম সেল) থাকতে হয়।
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এক যুগ আগে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যায় এখনও তদন্ত শেষ না হওয়াকে ‘বিচারিক দুর্বলতার উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় রায়ের পর্বেক্ষণে।
‘মৃত্যুদণ্ডের আসামি’ কখন বলা যাবে, সেই সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে ভারতের আদালতের ‘সুনীল বাত্রা বনাম দিল্লি প্রশাসন (১৯৮০)‘ মামলা প্রাসঙ্গিক বলে রায়ের পর্বেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, “কখন একজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি করা হবে? বিচারিক আদালত সাজা ঘোষণার পর নাকি রাষ্ট্রপতি ক্ষমার আবেদন গ্রহণ না করার পর? ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলার রায়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি ক্ষমার আবেদন গ্রহণ না করার পর দণ্ডিত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলা হবে।
“অর্থাৎ সব ধরনের আইনগত অধিকার সম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি বলা যাবে এবং তাকে কনডেম সেলে রাখা যাবে।“
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের কনডেম সেল থেকে সাধারণ সেলে স্থানান্তরের জন্যও কারা কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে বলেছে আদালত। সেজন্য সর্বোচ্চ দুই বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।