নিজস্ব প্রতিবেদকঃ এপ্রিল ২০০৬ থেকে আগস্ট ২০১৭। সময়ের হিসেবে প্রায় সাড়ে এগার বছর। প্রায় এক যুগ আগে ফতুল্লা টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে ভড়কে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে শক্তিশালী দলটির বিপক্ষে ১৫৮ রানের বিশাল লিড পায় লাল সবুজের দল। শাহরিয়ার নাফীস, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুলের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ অজি-বধের স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যানদের ভরাডুবি, বোলার এবং ফিল্ডারদের ব্যর্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত হার মেনেই মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ।
তবে এবার আর সেই ভুল করতে দিলেন না সাকিব-মুশফিকরা। প্রায় সাড়ে এগার বছরের সেই আক্ষেপটা মেটাল এবার বাংলাদেশ। মিরপুরে অজি-বধ করে আরেকটি রূপকথার জন্ম দিলো বাংলাদেশ। দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ২০ রানে হারিয়ে ঐতিহাসিক জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। আর এই জয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে জয়ের স্বাদ পেলো বাংলাদেশ।
এর আগে গত অক্টোবরে মিরপুরের উইকেটে ইংল্যান্ডকে ২৭৩ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল বাংলাদেশ। মিরাজের ঘূর্ণিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল তারা। ১৬৪ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল তাদের ইনিংস। বাংলাদেশ পেয়েছিল ঐতিহাসিক জয়ের দেখা।
মিরপুরে আজ রূপকথা জন্ম দেওয়ার কাজটা সহজ করে দিলেন সাকিব আল হাসান। কেননা, স্মিথ-ওয়ার্নারসহ ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের জয়কে সহজ করে দেন সাকিব। আর সাকিবের সাথে সফরকারীদের স্পিন ঘূর্ণিতে বেসামাল করেন আরেক স্পিনার তাইজুল ইসলাম। তিনিও শিকার করেন মুল্যবান তিনটি উইকেট। বলা যায়, স্পিনারদের হাত ধরে মিরপুরে আরেকটি ইতিহাস গড়তে সক্ষম হল বাংলাদেশ।
ইংল্যান্ড জয়ের টাটকা সুখস্মৃতি সামনে রেখে আজ এগিয়ে যেতে নেমেছিল বাংলাদেশ। দিনের শুরুটা হতাশ করে দিয়েছিলো ‘জীবন’ পাওয়া ওপেনার ওয়ার্নার। গতকাল ৭৫ রানে অপরাজিত খুব দ্রুত সেঞ্চুরি তুলে নেন। এটা তার ব্যক্তিগত ১৯তম শতক। তবে শতকের পর আগ্রাসী ওয়ার্নারকে (১১২) ফেরান সাকিব আল হাসান। ওয়ার্নার ফেরার পর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার মূল স্তম্ভ স্টিভ স্মিথ। স্মিথের এই মুল্যবান উইকেটটি নেন সেই সাকিবই। ব্যক্তিগত ৩৭ রানে ফিরে যান স্মিথ। স্মিথের পর ফিরে যান পিটার হ্যান্ডকম্ব। তারপর মাথু ওয়েড, ম্যাক্সওয়েল, আগার, কামিন্স, নাথান লিওনরা কেইউ ধরের ভার বহন করতে পারেনি। গুটিয়ে যায় ২৪৪ রানে। আর বাংলাদেশ জয় পায় ২০ রানে।
ক্রিকেট থেকে বাংলাদেশের অনেক প্রাপ্তি। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়, পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ সমৃদ্ধ করেছে টাইগারদের। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের গৌরবময় অগ্রযাত্রার সূচনা। পরের বছর টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে টাইগাররা আজ ক্রিকেটের সমীহজাগানো শক্তি। ২০০৫ সালে পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডেতে হারিয়ে ক্রিকেট-দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। এক যুগ পর পন্টিং-গিলক্রিস্ট-হেইডেন-ম্যাকগ্রাদের উত্তরসূরীরা পরাস্ত ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন লড়াইয়ের ক্ষেত্র টেস্টে।
অথচ বছর তিনেক আগেও কী খারাপ সময়ই না যাচ্ছিল বাংলাদেশের! এমনকি হংকংয়ের মতো দলের কাছেও হার মেনেছিল ঘরের মাঠের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। তবে মাশরাফির হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতেই চমকপ্রদ পরিবর্তন। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশকে অনেকেই পাত্তা দেয়নি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে, ইংল্যান্ডের মতো দলের হাতে দেশে ফেরার টিকিট ধরিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় টাইগাররা। ভারতের সঙ্গে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ‘বলি’ না হলে কে জানে, ক্রিকেটের সেরা আসরের সেমিফাইনালে হয়তো দেখা যেত বাংলাদেশকে।
বিশ্বকাপের হতাশা বুকে চেপে দেশে ফেরার পরেই মাশরাফির দলের দুরন্ত পারফরম্যান্স। প্রথমে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা, তারপর মোস্তাফিজের নৈপুণ্যে মধুর প্রতিশোধ নিয়ে ভারত-বধের আনন্দে মেতে ওঠা। দুর্ধর্ষ টাইগারদের আগুনে পুড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। টানা তিন সিরিজ জয়ের সৌরভ নিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ওপরে ওঠার সুখবর। এই সুখবরের প্রয়োজন ছিল খুব। কারণ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে হলে সেরা আটের মধ্যে থাকতে হতো। দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করে মর্যাদার টুর্নামেন্টে জায়গা করে নিতে সমস্যা হয়নি টাইগারদের। এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার ছাড়পত্রও হাতে আসার পথে।
ওয়ানডেতে টানা সাফল্য পেলেও টেস্টে ক্রমাগত ব্যর্থতা পীড়া দিচ্ছিল দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। তবে গত বছর ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড আর এ বছর শ্রীলঙ্কা সফরে ঐতিহাসিক শততম টেস্ট জিতে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, পাঁচ দিনের ক্রিকেটে উঠে আসতেও আর দেরি নেই। আর এবার তো অস্ট্রেলিয়া-বধের উল্লাস। এ যেন দেশবাসীকে মুশফিকদের অগ্রিম ঈদ উপহার।
শ্রীলঙ্কা সফরের সময় অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। আরও এগিয়ে হোয়াইটওয়াশের কথা বলতে দ্বিধা করেননি চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। সিরিজ শুরুর আগে কোচের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় সাকিব আল হাসানের কণ্ঠে। প্রতিপক্ষের কোচ ও সেরা তারকার মন্তব্যে একই সঙ্গে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্টিভেন স্মিথ। অতিথি অধিনায়ক বোধহয় বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ের কথা কল্পনাও করেননি। কিন্তু বাংলাদেশ যে আগের বাংলাদেশ নেই, অনেক বদলে যাওয়া দল। তাই অস্ট্রেলিয়ার মতো দলও পরাস্ত হলো, উড়লো বিজয়নিশান।
মিরপুর টেস্ট শেষ, এবার সামনে ‘মিশন চট্টগ্রাম’। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ওয়ানডেতে অনেক সাফল্য টাইগারদের। এ মাঠেই ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড হার মেনেছিল, দু বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়ও নিশ্চিত হয়েছিল এখানে। তবে টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য বলতে একটিই- বছর তিনেক আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়। তাই চট্টগ্রামে সাকিব-তামিমদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় টেস্ট জিততে পারলে টাইগারদের অর্জনের মুকুট সমৃদ্ধ হবে আরও, অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশের উল্লাসে মেতে উঠবে সারা দেশ। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ৩০ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস