গরমে সুস্থ্য থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হিট স্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ; মৌলভীবাজার জেলাসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা, রংপুর ও বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে করে জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হিটস্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পাশাপাশি হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ।
চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র গরম, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি খাওয়ার কারণেই ঢাকাসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে জ্বর, সর্দি, হিটস্ট্রোক, ডায়রিয়া, টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গরম বাড়লে আরও রোগী বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই গরমে সুস্থ থাকতে অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সুতি কাপড় পরা এবং বেশি বেশি পানি পান করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তবে বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ৫০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। এরমধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু এবং বাকি ৪০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক রোগী রয়েছেন বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা। শিশু হাসপাতালে গড়ে ৭০০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। একইভাবে, সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারেও বেড়েছে রোগীদের চাপ।
আইসিডিডিআর,বি-এর হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আইসিডিডিআর,বি-তে দিনে ৭০০ এর বেশি রোগী ভর্তি হলে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। গ্রীষ্মের শুরুতে এখনও সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে রোগী বাড়ছে। তিনি বলেন, গরমে ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, খাবার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যারা শিশুদের খাওয়ান, যতœ নেন, তাদের এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
আইসিডিডিআর,বি বলছে, তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রিকশাচালক, কৃষক ও নির্মাণশ্রমিকদের মত শ্রমজীবী, যাদের ওজন বেশি এবং শারীরিকভাবে অসুস্থু বিশেষ করে যাদের হƒদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী: গত কয়েকদিন ধরেই দেশে তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। গত বুধবার দুপুর ৩টায় সব রেকর্ড ভেঙ্গে এ বছর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে গত কয়েক দিন ধরে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৫ শতাংশ। চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আগামী পাঁচ দিন বৃষ্টির তেমন আভাস নেই। তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, বৈশাখের শুরুতে গরমে হাঁপিয়ে উঠছে চুয়াডাঙ্গার মানুষ। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার হাসপাতালগুলোতেও গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
ঈদের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গরমজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু ভর্তির হারও বেড়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সাহিদা ইয়াসমিন জানান, এই গরমে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। এছাড়া জ্বর, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু ভর্তির হারও বাড়ছে। হাসপাতালের চারটি ওয়ার্ডে এখন ৫০০ মতো শিশু ভর্তি আছে। গরম বৃদ্ধির সাথে সাথে নারায়ণগঞ্জে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। শহরের ১০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঈদের পর থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী সেবা নিচ্ছেন ডায়রিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে। হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ শিউলি আক্তার বলেন, এখন দৈনিক গড়ে ৫০ জন রোগী আসছেন। ঈদের পর রোগীদের চাপ বেড়েছে। গরমের কারণে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা রোগীদের পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ প্রদান করে যাচ্ছি।”
একইভাবে প্রচণ্ড গরমে নওগাঁর জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে জেলায় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমে হাসপাতালে বাড়ছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী। তাদের বেশির ভাগই বয়স্ক ও শিশু। হঠাৎ রোগীর চাপ বাড়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। নওগাঁ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এক সপ্তাহে কমপক্ষে ৩০০ রোগী ভর্তি হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগ বয়স্ক ও শিশু। আক্রান্ত হচ্ছেন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দি ও জ্বরে। হাসপাতালের পঞ্চম তলায় শিশু ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৫টি হলেও ভর্তি রয়েছেন ৫৬ জন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া রোগী ২৬ জন। তবে হাসপাতালে থেকে বাড়তি রোগীদের জন্য অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৭০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। যার অধিকাংশ ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগী।
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, গত সাত দিনে জেলার ১১টি উপজেলায় অন্তত ৭৯৮ জন ডায়রিয়ার এবং ২৪ জন কলেরার (এআরআই) চিকিৎসা নিয়েছেন। জেলা বদলগাছী আবহাওয়া কৃষি পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর সর্বনি¤œ ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তীব্র গরমে সুস্থ থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ: তীব্র গরমের কারণে সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বলছেন, এমন তীব্র গরমে মানুষের সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এই গরমেও নিরাপদ ও ভালো থাকা যায়। যেমন- এ সময় বাইরে বের হলে সবাইকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। প্রচুর পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন ও তরল খাবার খেতে হবে। তেল-মশলাজাতীয় খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। শরীরের কোনো অংশে সরাসরি রোদ লাগানো যাবে না। বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, সানগ্লাস ও ছাতা, মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে। রাস্তার খোলা খাবার পানি বা সরবত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কোথাও যাওয়ার আগে সঙ্গে অবশ্যই নিরাপদ খাবার পানি নিতে হবে।
তীব্র গরমে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, হঠাৎ করেই তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় সুস্থ থাকতে আমাদের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই গরমে সরাসরি রোদে যত কম যাওয়া যায়, ততই ভালো।
তিনি বলেন, এই সময়ে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক বেশি লবণ বের হয়ে যায়। এতে অবসাদ, ক্লান্তি ও মাথা ঘোরার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। প্রয়োজনে হালকা লবণ মিশ্রিত পানি কিংবা স্যালাইন খাওয়া যেতে পারে।