গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা নিয়ে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিতে ক্ষোভ রয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন, পশ্চিমাবিশ্বসহ আন্তর্জাতিক চাপ সত্তে¡ও ভারতের সমর্থনেই আওয়ামী লীগ গত ৭ জানুয়ারি একটি ডামি নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের আকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। এই কারণেই গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকেই বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে ভারতের ভ‚মিকা নিয়ে সমালোচনা করে বক্তব্য বিবৃতি দেয়া শুরু করেন। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দলের নেতাকর্মীদের প্রতিবেশী ভারতের ভ‚মিকা নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার প্রকাশ্য সমালোচনা করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তবে ভারতবিরোধিতার রাজনীতিতে বিএনপি আসলে কতটা অগ্রসর হবে, এই নিয়ে দলটিতেই ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
ভারত বিরোধিতার অবস্থান নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেই অস্পষ্টতা রয়েছে। এরই মধ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটি আন্দোলনের বিষয় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত ২০ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেদিন তিনি নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন। তার সঙ্গে থাকা এক দল নেতাকর্মী সেখানে চাদরটি আগুন দিয়ে পোড়ান। এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, ভারতীয় চাদর ফেলে দিয়ে তিনি দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছেন। তার এমন প্রতিবাদের বিষয়টি দল জানে বলে দাবি করেন তিনি। বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, রুহুল কবির ব্যক্তিগত আবেগ থেকে, নাকি দলীয় সিদ্ধান্তে ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এটি তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ বিষয়টিকে একটি ‘সামাজিক আন্দোলন’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সরাসরি যুক্ত হওয়াটা সঠিক হবে বলে মনে করছেন না দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা। তবে এরই মধ্যে আলোচনায় আসা এই সামাজিক আন্দোলন বিএনপি উপেক্ষা করবে, নাকি কৌশলী অবস্থান নেযে সে ব্যাপারে দলটি এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারতীয় পণ্য বর্জন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তী বৈঠকে দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি দলের একজন দায়িত্বশীল নেতার ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণার প্রসঙ্গ তুলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি বৈঠকে আলোচনায় আনেন। একজন সদস্য জানতে চান, ভারতীয় পণ্য বর্জনে তার ঘোষণা দলীয় সিদ্ধান্তে কি না, সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে সেটি কোথায় হয়েছে। আরেক সদস্য প্রশ্ন তোলেন, বিএনপি ক্ষমতাপ্রত্যাশী একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দল ক্ষমতায় গেলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কী হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ভারত ইস্যুতে দলের অবস্থান কী হবে, এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হয়েছে। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তীতে বৈঠকে আলোচনা করে দলের অবস্থান ঠিক করা হবে। প্রায় এক দশক আগে থেকে প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার একটা চেষ্টা ছিল বিএনপির। বিশেষ করে ২০১২ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর থেকেই প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা থেকে সরে আসে দলটি। বিএনপির ভোট বর্জনের মুখে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে ভারত সরকার ও দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে বিএনপি।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের পুরনো জোট ভেঙে দেয়। দলটির নেতারা ভারত নিয়ে কোনো ইস্যুতে বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকেন। এমনকি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ও ভারত প্রশ্নে সতর্ক ছিল বিএনপি; বরং বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত কোনো দলের পক্ষ না নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে ভ‚মিকা রাখবে, এ ধরনের বক্তব্য বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে আস্থায় নেয়নি বলে দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা মনে করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাদের আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো একটা অবস্থান নেয়ার পরও ভারতের ভ‚মিকার কারণে আওয়ামী লীগ ৭ জানুয়ারির নির্বাচন করতে পেরেছে। আর এই ধারণা থেকেই বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকের মাঝে আবার ভারতের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের বড় অংশই ক্ষুব্ধ হয়েছে। এমন পটভ‚মিতে এখন আবার ভারতবিরোধী বক্তব্য বিবৃতি দেয়া শুরু করেছেন বিএনপির নেতারা। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক সামাজিক আন্দোলন মনে করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, এটা তো সামাজিক আন্দোলন। এটাকে পার্টিজান করা ঠিক নয়, এতে বিএনপির যুক্ত হওয়ার দরকার নেই। সামাজিক আন্দোলন সাধারণ মানুষের বিবেকবোধের আন্দোলন, এটা এভাবেই চলা উচিত। বিএনপির নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির সদস্য মনে করেন, দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও ভোটাধিকার-বঞ্চিত জনগণ তাদের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ থেকে নির্বাচনের পর ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এটি সামাজিক আন্দোলন। কারণ, জনগণ মনে করছে, আওয়ামী লীগকে এতটা ‘বেপরোয়া’ এবং ‘দুর্বিনীত’ করতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সহযোগিতা করছে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র। এতে বিএনপি প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া সঠিক হবে না।