রমজান মাসে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক কমানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। এসব কারণে বাজারে স্বস্তি আসবে বলে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশাও করেছিল। কিন্তু তিনটি রোজা চলে গেলেও বাজারে গিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না ক্রেতা। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে মাংসসহ ইফতারি পণ্য ছোলা, চিনি, খেজুর, বেগুন, শসা, টমেটো ও লেবুর দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
রমজানেও নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি নেই ক্রেতার
ইফতারের অন্যতম উপকরণ খেজুরের দাম সরকার বেঁধে দিলেও মানছেন না ব্যবসায়ীরা, আগের বাড়তি দামেই বিক্রি করছেন। এতে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছরই রমজান মাস ঘিরে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা রোজার পণ্যকে টার্গেট করে দাম বাড়িয়ে দেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা বাজার তদারকিতে কাজ করছে। তার পরও পণ্যের দামে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তাই রোজায় ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে সরকারকে বাজার তদারকিতে আরো জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তাঁদের।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা, বাড্ডা কাঁচাবাজার, মহাখালী কাঁচাবাজার, জোয়ারসাহারা বাজারসহ বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবারও রোজায় বেগুনের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে দামও বেড়ে গেছে।
গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বেগুন বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। ইফতারের শরবতের অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ লেবুর চাহিদা প্রতিবছরই ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে লেবুর দাম দ্বিগুণ হারে বেড়ে মাঝারি আকারের লেবুর হালি ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। দেশি শসা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় এবং হাইব্রিড শসা ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও দেশি শসা প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং হাইব্রিড শসা ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
৫০ থেকে ৬০ টাকায় কেজিতে বিক্রি হওয়া ক্ষীরা সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। কাঁচা মরিচ কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকায়।
ইফতারিতে প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যান্য সবজি ও নিত্যপণ্যের দামে তেমন পরিবর্তন নেই। প্রতি কেজি শিম ৬০ থেকে ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, বাঁধাকপি প্রতি পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ফুলকপি প্রতি পিস ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চালকুমড়া প্রতি পিস ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটোল কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা, প্রতিটি লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিন-চার দিন ধরেই বেগুন, শসা ও লেবুর বাজার আগুন। এখন কারওয়ান বাজারেই ১০০ টাকার নিচে শসা কেনা যাচ্ছে না। ভালো মানের বেগুনও ১০০ টাকায় পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে। মূলত বাজারে চাহিদা বাড়ার কারণে কয়েকটি পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তবে এই দাম বেশিদিন থাকবে না। খুব দ্রুতই কমে আসবে।’
জোয়ারসাহারা বাজারের মোহাম্মদ পিয়াস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সপ্তাহের ব্যবধানে রোজায় বেশি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম অনেক বেড়েছে। তার মধ্যে শসা, বেগুন ও লেবুর দাম বেড়ে পাইকারি বাজারেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাই খুচরা বাজারেও প্রভাব পড়েছে। তবে অন্যান্য সবজির দাম তেমন বাড়েনি, আগের মতোই রয়েছে।’
একই বাজারে কথা হয় ক্রেতা নিলুফা বেগমের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম রোজার দিন শসা ও বেগুনের দাম শুনে আর কেনার সাহস পাইনি। শসার পরিবর্তে টমেটো নিয়েছিলাম। বাড়তি দামের কারণে দুই দিন শসা ও বেগুনি ছাড়াই ইফতার করেছি। ছেলেমেয়েরা ইফতারে শসা না পেয়ে চিল্লাচিল্লি করার কারণে আজ বাধ্য হয়েই হাফ কেজি দেশি শসা ৭০ টাকায় কিনে নিলাম। তবে দাম না কমা পর্যন্ত এবার বেগুনি খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছি।’
বর্তমান বাজার পরিস্থিতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আরেক ক্রেতা আব্বাস আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা তাঁদের মতো করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন, কেউ কিছু বলছে না। সরকারের পক্ষ থেকেও বাজার তদারকিতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতিটি দেশেই ব্যবসায়ীরা রোজায় লাভের পরিমাণ কমিয়ে বিক্রি করছেন, কিন্তু শুধু বাংলাদেশেই উল্টো চিত্র। যে যেভাবে পারছে রোজায় মানুষকে জিম্মি করে পকেট কাটছে।’
ইফতারসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম অনুষঙ্গ ছোলার দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেড়ে মানভেদে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে থেকেই উচ্চ দামে বিক্রি হওয়া খোলা চিনি এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আগের দামেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ খুচরায় ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগি কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকায় এবং মানভেদে সোনালি মুরগি কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি কেজি ২০০ থেকে ২১০ টাকায় এবং সোনালি মুরগি কেজি মানভেদে বিক্রি হয়েছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। যদিও মাঝে প্রথম রোজার আগের দিন কেজিতে আরো ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হয়েছিল। দাম বেড়ে গরুর মাংস কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোজার আগের দিন আর প্রথম রোজায় ব্যাপকভাবে মুরগি বিক্রি হয়েছে। তখন দামও কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। এখন মুরগির বিক্রি কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে দু-তিন দিন আগের তুলনায় দাম কিছুটা কম। তবে গত সপ্তাহের তুলনায় দাম কিছুটা এখনো বাড়তি।’
সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না খেজুর
গত সোমবার সরকার অতি সাধারণ মানের খেজুরের দাম প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং দেশে বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুরের দাম প্রতি কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব ফলের দোকানগুলোতে দেখা যায়নি। বেঁধে দেওয়া দামে কেউ বিক্রি করছেন না এসব খেজুর।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি জাইদি খেজুর ২৮০ থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুরের সরকার নির্ধারিত দাম সর্বোচ্চ ১৬৫ টাকা। কিন্তু এসব খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। সাধারণ মানের খেজুর প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে ভালো মানের খেজুর এক হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজারে সরকার নির্ধারিত খেজুরের দাম কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, সরকার যে হারে দাম বেঁধে দিয়েছে সেই দামেই পাইকারি বাজার থেকে তাঁদের কিনে আনতে হয়েছে। পাইকারি বাজার থেকে বাড়তি দামে খেজুর কেনার কারণে তাঁরা সরকারের নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারের নির্ধারিত দামে খেজুর বিক্রি করতে হলে তাঁরা লোকসানে পড়বেন।
খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণসংক্রান্ত স্মারকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে আমদানি করা বিভিন্ন মানের খেজুরের আমদানি মূল্য, আরোপিত শুল্ক, কর এবং আমদানিকারকদের অন্যান্য খরচ বিশ্লেষণ করে খেজুরের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।