জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব করে দলটির একাংশের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে এরশাদের ছেলে আল মাহগির শাদ এরশাদকে দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
এতে নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া কাজী ফিরোজ রশীদকে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত জাতীয় পার্টির কার্যক্রম দুই ভাগে প্রকাশ্যে আসলো। ভেঙে গেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি। যদিও এমন ভাঙন দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায়ও ৪ বার ঘটে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর রমনা ইনস্টিটিউটের সামনের খোলামাঠে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম ঘোষণা করলে উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা দুহাত উঠিয়ে তা সমর্থন জানান। এরপর দলের অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর দলের অন্য সিনিয়র নেতাদের নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে কাজী ফিরোজ রশিদকে নির্বাহী চেয়ারম্যান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, আল মাহগির শাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়কে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই নাম ঘোষণার পর উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের কাছে মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনূর রশীদের নাম ঘোষণা করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। এতে উপস্থিত সবাই তা সমর্থন করেন।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় পুরো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ মৎস্যভবন এবং শাহবাগ এলাকা। নানা রং-বেরঙের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে সম্মেলনস্থল। সড়কদ্বীপগুলোতে লাগানো হয়েছে এরশাদ শাসনামলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ছবি সম্বলিত ফেস্টুন। নির্মাণ করা হয় দ্বিতল বিশিষ্ট মঞ্চ। ১২ হাজার কাউন্সিলর এবং ডেলিগেট উপস্থিতি ছিল সম্মেলনে। সম্মেলনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নেতৃত্বে প্রায় ২০ নেতাকর্মী অংশ নেন। তার অনুসারীরা ব্যাপক শোডাউন করে পুরো অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে। এছাড়া শফিকুল ইসলাম সেন্টুরও হাজারো সমর্থকরা অংশ নেন।
রাজধানী ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকেও নেতাকর্মীরা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। সম্মেলন উপলক্ষে রাজধানী বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার-ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। জি এম কা?দেরপন্থি শীর্ষ নেতাদের যোগদানের মধ্য দিয়ে কাউন্সিলে চমক দেখানোর কথা থাকলেও কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত দলের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা ছাড়া দলের উল্লেখযোগ্য নেতাকর্মী সম্মেলনে যোগ দেননি। কাউন্সিলে ছিল না রওশন এরশাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ, এসএমএম আলম, ইকবাল হোসেন রাজুসহ বড় একটি অংশ।
প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদের উপস্থিতিতে এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সাবেক মন্ত্রী এবং জাপার একাংশের মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন, বিএলডিপি চেয়ারম্যান এম নাজিম উদ্দীন আল আজাদ, বাংলাদেশ হিউম্যান পার্টির চেয়ারম্যান, চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত ফেং জিজিয়া প্রমুখ। এর আগে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পার্টির দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা। এতে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন রওশন এরশাদ অনুসারী জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ। সম্মেলনে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম সারোয়ার মিলন, সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ক্বারী হাবিবুল্লাহ বেলালী, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, শাদ এরশাদ, নুরুল ইসলাম নুরু, রফিকুল হক হাফিজ, এমএ গোফরান, ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরী, শেখ আলমগীর হোসেন, নুরুল ইসলাম নুরু, নিগার সুলতানা রানী, এমএ কুদ্দুস খান, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, শফিকুল ইসলাম শফিক, আমানত হোসেন, হাজী তুহিনুর রহমান নূরু হাজী, মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, হাজী নাসিরসহ জাতীয় পার্টির অসংখ্য কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত আছেন। এছাড়াও সারাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কাউন্সিলর ও ডেলিগেট সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে জাতীয় পার্টি ভেঙে একই নামে হয় ৫টি দল। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির যাত্রা শুরু হয়। এরপর নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে অন্তত ছয় ভাগে বিভক্ত হয়েছে দলটি। তারপর থেকে এরশাদ-রওশন ও জিএম কাদের বলয়কেই জাপার মূল ধারা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনা শাসক এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই নেতৃত্ব নিয়ে রওশন, কাদের অর্থাৎ দেবর-ভাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কোন্দলের মাত্রা চরমে ওঠে। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা সরাসরি পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে সভা ডেকে ফল বিপর্যয়ের জন্য দোষারোপ করেন। তাদের পদত্যাগও চান পরাজিত প্রার্থীদের অনেকেই। এ ঘটনা কেন্দ্র করে দলে থাকা দীর্ঘদিনের মিত্রদের একে একে বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। এর মধ্যে গত ২৮ জানুয়ারি জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাপার স্বঘোষিত চেয়ারম্যান হন রওশন এরশাদ। মূলত রওশন অংশে তিনি ছাড়া বাকি শীর্ষ নেতাদের সবাই দল থেকে বহিষ্কৃত। বহিষ্কৃত নেতাদের হাতে নিয়েই নতুন করে দল গঠন করতে করে সাবেক এই বিরোধী দলের নেতা। যদিও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রওশনকে এখনো বহিষ্কার করেননি জিএম কাদের। গতকাল দলটির একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপায় সবচেয়ে বড় ভাঙন হয়। যদিও ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে রংপুরসহ ১৭টি জেলা সম্মেলনে যোগ দেয়নি। অন্য জেলার নেতাকর্মীরাও কমবেশি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। তবে কেন্দ্রের বিরোধের কমবেশি প্রভাব পড়েছে সবখানেই। বিভক্তি প্রসঙ্গে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর ও রওশনের সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে অনেক চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। জাপা ভাঙছে। এজন্য কে দায়ী, তা হয়তো সময় মূল্যায়ন করবে।
এদিকে সভাপত্বির বক্তব্যে বেগম রওশন এরশাদ বলেন, আজ আমার রাজনৈতিক জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। আমার গড়া প্রানপ্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টি- এই রকম একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছে দেখে- আমার হƒদয় কানায় কানায় ভরে গেছে। এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য- জাতীয় পার্টির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আজ যদি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হতো- তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেতো। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ- জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। পল্লীবন্ধু এরশাদ এদেশে যে নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতির প্রবর্তন করে ছিলেন- সেই রাজনীতি হারিয়ে যেতে বসেছিলো। আজ এই দশম সম্মেলনের মাধ্যমে পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনে আবার আমরা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি- এই সম্মেলনের মাধ্যমে। রওশন বলেন, আমরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখনো টিকে আছি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর যখন একটু ঘুরে দাঁড়ালাম- তখন আমাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিজেদের আয়ত্বে রাখার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিলো। মাননীয় আদালতের সুবিচারে- পল্লীবন্ধু এরশাদ এবং আমি রওশন এরশাদ লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেই লাঙ্গল প্রতীক- এখনো আমাদের জাতীয় পার্টির অনুকূলে আছে এবং আগামীতেও থাকবে-ইন্শাআল্লাহ। সম্মেলনে সাদ এরশাদ বলেন, আজ এমন একটি সম্মেলনে আপনাদের সামনে দু’টো কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আজ আমার অনেক বেশি ভালো লাগছে- আমার আব্বুর রেখে যাওয়া তার প্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টিকে আবার সুসংগঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার করণে- শিশু বয়সেই মায়ের হাত ধরে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিলো। আজ আবার রাজনীতির জন্যে মায়ের হাত ধরে আপনাদের সামনে এসেছি। আপনারা যদি আমাকে আপনাদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন- তাহলে আমিও অঙ্গীকার করছি- আব্বুর দেখানো পথ ধরে আমি সব সময় আপনাদের সাথে নিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করে যাব।