সম্ভবত আপনি লিবিডো বা কামশক্তি বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক পন্থা অবলম্বন করেছেন এবং তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথবা হয়তো আপনি বয়স্কতার জন্য উদ্বিগ্ন এবং টেস্টোস্টেরন ঘাটতি সমস্যার অলৌকিক সমাধানের জন্য টেস্টোস্টেরন বুস্টারের দিকে ঝুঁকছেন।
কিন্তু কৌশলী মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে প্রলুব্ধ হয়ে টেস্টোস্টেরন বুস্টার বা টেস্টোস্টেরন ওষুধ গ্রহণের কথা বিবেচনা করার পূর্বে আপনার টেস্টোস্টেরন সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া উচিত। এখানে ৯টি প্রশ্নের উল্লেখ করা হলো, যা পুরুষদের ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা উচিত।
১. টেস্টোস্টেরন কি?
টেস্টোস্টেরন একটি স্টেরয়েড হরমোন যা কোলেস্টেরল থেকে অর্জিত হয়। টেস্টোস্টেরনকে অ্যান্ড্রোজেন বা পুরুষ হরমোন বলা হয়। এই হরমোন কমে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, লিঙ্গোত্থানে সমস্যার মতো ঘটনা ঘটে। এই হরমোন প্রধানত পুরুষদের শুক্রাশয় দ্বারা নিঃসৃত হয়ে থাকে, কিন্তু খুব অল্প পরিমাণ টেস্টোস্টেরন নারীদের অ্যাড্রিনাল কর্টেক্স ও ডিম্বাশয় দ্বারাও নিঃসৃত হয়। বয়ঃসন্ধিকালে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যায়, কৈশোরের শেষের দিক থেকে ২০ বছর বয়সের প্রারম্ভে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা সর্বাধিক হয় এবং তারপর এ মাত্রা কমতে থাকে। ৩০ বছর বয়সের পর, একজন পুরুষের টেস্টোস্টেরন মাত্রা ধীরে ধীরে কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক এবং এ হ্রাস পাওয়া প্রতিবছর অব্যাহত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের মতে, ‘টেস্টোস্টেরন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ হরমোন যা কামোন্নয়ন বা যৌনোন্নয়ন, মাসল মাস বা মেটাবলিক রেট বা শারীরিক শক্তি ও দৈনিক কার্যক্ষমতা এবং লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।’ ১৯৩৭ সালের প্রথম দিকে ক্লিনিক্যাল ড্রাগ হিসেবে প্রথম সিন্থেটিক টেস্টোস্টেরন ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমানে সিন্থেটিক টেস্টোস্টেরন সেসব পুরুষদের প্রেসক্রাইব করা হয়, যাদের প্রাকৃতিকভাবে টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের মাত্রা কম।
২. আমার কি টেস্টোস্টেরন কম রয়েছে?
টেস্টোস্টেরন ঘাটতির কোন মাত্রা মেডিক্যালি প্রাসঙ্গিক তা এখনো ভালোভাবে নির্ণীত হয়নি। এটি শুধুমাত্র বয়স্ক পুরুষদের সমস্যা নয়। টেস্টোস্টেরন ঘাটতি পুরুষের যৌন স্বাস্থ্য সমস্যাসমূহের একটি যার সম্পর্কে পুরুষদের জ্ঞান থাকা উচিত। স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন উৎপাদন মাত্রা পুরুষদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এবং সারাদিন এ হরমোনের মাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে- সাধারণত সকালে সর্বোচ্চ হয়ে থাকে। লো টেস্টোস্টেরন বা নিম্ন টেস্টোস্টেরন বা টেস্টোস্টেরন ঘাটতির আদর্শ কোনো সংজ্ঞা নেই। লো টেস্টোস্টেরনকে ‘লো-টি’ নামে উল্লেখ করা হয়। মায়ো ক্লিনিকের মতে, গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের (৩০+) স্বাস্থ্যতার পরিচায়ক টেস্টোস্টেরন মাত্রা প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ২৭০ থেকে ১,০৭০ ন্যানোগ্রাম। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের মতে, লো-টি এর সম্ভাব্য উপসর্গ হচ্ছে যৌন তাড়না হ্রাস, লিঙ্গ উত্থান অক্ষমতা বা পুরুষত্বহীনতা, স্তনের আকার বৃদ্ধি, শুক্রাণু হ্রাস, হট ফ্ল্যাশ, বিষণ্নতা, খিটখিটে মেজাজ, মনোযোগে অসমর্থতা, সংকুচিত ও নরম টেস্টিস, মাসল মাস হ্রাস, চুল পড়ে যাওয়া এবং হাড়ে ফ্র্যাকচার প্রবণতা।
৩. লো-টি কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
অধিকাংশ পুরুষের পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরনের চেয়েও বেশি টেস্টোস্টেরন থাকে। কিন্তু কিছু পুরুষের মধ্যে এ হরমোন পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত হয় না- যা তাদেরকে হাইপোগোনাডিজম নামক অবস্থার দিকে ধাবিত করে। একটি রক্ত পরীক্ষা আপনার ডাক্তারকে বলতে পারবে যে কি পরিমাণ মুক্ত টেস্টোস্টেরন আপনার রক্তে চলাচল করছে এবং এটাও জানাতে পারে যে আপনার শরীরে মোট কি পরিমাণ হরমোন আছে। দ্য জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজমে প্রকাশিত এন্ডোক্রাইন সোসাইটির নির্দেশিকার মতে, শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে সুসংগত উপসর্গ এবং সুস্পষ্ট নিম্ন সিরাম টেস্টোস্টেরনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে লো-টি নির্ণয় করা উচিত। লেবেলিং এবং মেডিকেটিং বা ওষুধ এড়াতে নির্দেশিকাটিতে পুরুষদেরকে সাধারণ লোকদের মধ্যে স্ক্রিনিং না করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, অন্যথায় সুস্থ পুরুষদের টেস্টিং, ট্রিটমেন্ট এবং মনিটরিংয়ে অস্পষ্ট ফলাফল আসতে পারে।
৪. লো-টি কি বয়স্কতার সঙ্গে একটি অনিবার্য অংশ?
নারীরা যখন মেনোপজের মধ্য দিয়ে যায়, তাদের ইস্ট্রোজন মাত্রা খুব দ্রুত হ্রাস পায় এবং প্রায় সম্পূর্ণরূপে থেমে যায়। কিন্তু পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন মাত্রা হ্রাস ভিন্নভাবে হয়ে থাকে। সাধারণত, ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ২ শতাংশ টেস্টোস্টেরন মাত্রা হ্রাস পায় এবং লো-টি অবশ্যই অনিবার্য নয়। ব্রিটিশ মেডিক্যালের ২০১০ সালের জুন সংখ্যার ড্রাগ অ্যান্ড থেরাপিউটিকস বুলেটিনের মতে, ৬০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের আশি বা তদোর্ধ্ব বছর বয়সে টেস্টোস্টেরন মাত্রা অল্পবয়স্ক পুরুষদের মতো স্বাভাবিক রেঞ্জের মধ্যে ছিল।
৫. কিভাবে আমি লো-টি এর চিকিৎসা করব?
লো-টি থাকা পুরুষদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির (টিআরটি) মাধ্যমে এ অবস্থার চিকিৎসা করা যায়। এজন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন এবং সাবধানী মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ লাগবে। বিভিন্ন রূপে ওষুধ পাওয়া যায়, যেমন- জেল, টপিক্যাল সল্যুশন, চর্মের ওপর ট্রান্সডারমাল প্যাচ স্থাপন, উপরের মাড়িতে বাক্কেল প্যাচ প্রয়োগ, ইনজেকশন এবং চর্মের নিচে পেলেট ইমপ্লান্ট। এসব ওষুধ বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে পাওয়া যায়, যেমন- অ্যান্ড্রোডার্ম, অ্যান্ড্রোজেল, অ্যাক্সিরন, ফরটেস্টা, স্ট্রিয়ান্ট, টেস্টিম এবং টেস্টোপেল। শক্তি বৃদ্ধি, অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স, শারীরিক সৌন্দর্য কিংবা বয়স্কতা প্রতিরোধের জন্য যদি আপনি টেস্টোস্টেরন গ্রহণের চিন্তা করেন, তাহলে এ কথা মনে রাখবেন যে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন(এফডিএ) এসব ক্ষেত্রে এ ড্রাগ ব্যবহারের অনুমোদন দেননি।
৬. টেস্টোস্টেরন গ্রহণের কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে?
টেস্টোস্টেরন গ্রহণে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধিসহ কিছু ভীতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদি আপনি টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি গ্রহণের কথা বিবেচনা করেন, তাহলে নিশ্চিত হোন যে আপনি সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে জেনেছেন। মায়ো ক্লিনিকের মতে, এসব ঝুঁকি হতে পারে ব্রণ বা তৈলাক্ত ত্বকের বিকাশ, তরল জমা, প্রস্রাবের উপসর্গ বৃদ্ধির সম্ভাবনা (যেমন- প্রস্রাবের তাড়া বা ঘনঘন প্রস্রাব), বৈরভাব ও দোদুল্যমান মেজাজ, স্লিপ অ্যাপনিয়া বৃদ্ধি, অণ্ডকোষের আকার হ্রাস, স্তন বৃদ্ধি এবং রক্তজমাটের ঝুঁকি বৃদ্ধি। রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করতে ২০১৪ সালে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন(এফডিএ) টেস্টোস্টেরন প্রোডাক্টের লেবেল রিভাইজ করে। টেস্টোস্টেরন গ্রহণকারী রোগীদের বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস সমস্যা, শরীরের একপাশে দুর্বলতা অথবা কথা অস্পষ্ট হলে এফডিএ মেডিক্যাল সেবা অনুসন্ধানের পরামর্শ দেয়।
৭. আমি কি প্রাকৃতিকভাবে টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি করতে পারব?
স্থূল পুরুষদের টেস্টোস্টেরন কম থাকে। তাদের মতো ধূমপায়ী, শারীরিকভাবে অলস অথবা প্রতিসপ্তাহে ২৮ বারের বেশি মদ্যপায়ীদেরও টেস্টোস্টেরন কম থাকে। তাই ওজন হ্রাস করে, বেশি করে কর্মে সক্রিয় হয়ে এবং মদ্যপান কমিয়ে আপনি প্রেসক্রিপশন ছাড়া টেস্টোস্টেরন মাত্রা বাড়াতে পারেন। ২০১২ সালে এন্ডোক্রাইন সোসাইটির বার্ষিক সভায় উপস্থাপিত গবেষণা ফলাফলের মতে, যেসব স্থূল পুরুষেরা গড়ে ১৭ পাউন্ড ওজন কমিয়েছে, তাদের টেস্টোস্টেরন মাত্রা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিনে ২০১৪ সালে প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যায়, হাই ইন্টেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেইনিং (এইচআইআইটি) টেস্টোস্টেরন মাত্রা বাড়াতে পারে।
৮. টেস্টোস্টেরনের জন্য কি খারাপ সহযোগী আছে?
স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন মাত্রা থাকা পুরুষদের টেস্টোস্টেরন থেরাপি বিবেচনা করা উচিত নয় এবং ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়া পুরুষ বা নারীদের টেস্টোস্টেরন প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত নয়। ধারণা করা হয় যে, টেস্টোস্টেরন প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে অথবা এনলার্জড প্রস্টেটের উপসর্গকে আরো খারাপ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করতে পারে- এ বিষয়টা নিয়ে মেডিক্যাল কমিউনিটির মধ্যে অনেক বছর ধরে তর্কবিতর্ক হয়েছে। সায়েন্স ডেইলিতে প্রকাশিত এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোন মেডিক্যাল সেন্টার এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন দ্বারা ২০১৬ সালে সম্পাদিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, টেস্টোস্টেরন থেরাপি আগ্রাসী প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবুও আপনার প্রস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে টেস্টোস্টেরন থেরাপি শুরু করার পূর্বে ডাক্তারকে জানান।
৯. টেস্টোস্টেরন গ্রহণ কি অন্যের ঝুঁকির কারণ হবে?
টেস্টোস্টেরন মেডিকেশন বা ওষুধের মোড়কে সতর্কবাণী লেখা থাকে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সতর্ক করে যে, যেসব শিশুরা ঘটনাক্রমে এ হরমোন এক্সপোজ করে- তাদের পেনিস বা ক্লিটরিস বৃদ্ধি, গুপ্ত লোম জন্মানো, লিঙ্গ উত্থান ও কামশক্তি বৃদ্ধি, আগ্রাসী মনোভাব এবং হাড়ে বার্ধক্য আসতে পারে। তাই শরীরের সেসব জায়গায় টেস্টোস্টেরন প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত নয় যা শিশু বা গর্ভবতী নারীর সংস্পর্শে আসতে পারে। এ প্রোডাক্ট প্রয়োগ করার পর প্রয়োগকৃত স্থান কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত এবং সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। কারো সঙ্গে চর্ম-থেকে-চর্ম সংস্পর্শ হওয়ার পূর্বেই টেস্টোস্টেরন প্রোডাক্ট প্রয়োগকৃত স্থান ধুয়ে ফেলা উচিত। টেস্টোস্টেরন গ্রহণকারীর বেড শিট, বালিশ এবং কাপড়ে টেস্টোস্টেরন লেগে থাকতে পারে, তাই এসবের সংস্পর্শে কেউ আসতে চাইলে তাকে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করুন। তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, ৭ নভেম্বর, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/পিকে