বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার আনার চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। তাই নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা ভোটের আগে চষে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। প্রার্থীদের তাগিদ দিয়েছেন বারবার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ৬০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখীই হননি। এ নিয়ে ইসির অতৃপ্তির শেষ নেই। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় মিলেছে স্বস্তি। অধিকাংশ ভোটার কেন্দ্রে না আসার দায়ও এড়িয়ে গেছে সুকৌশলে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ইসির কাজ হচ্ছে ভোট আয়োজন করা। কেউ ভোট দিতে আসবেন কি আসবেন না সেটি দেখা ইসির দায়িত্ব নয়। আর নির্বাচনে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সেটির দায়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এতেই তৃপ্ত, পরিতৃপ্ত। দলটির দাবি, বিএনপির নির্বাচনবিরোধী অপপ্রচার, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টার পরও সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক। এটি গণতন্ত্রের জয়।
নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন দিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়ন হয়েছে। ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল রবিবার ভোটগ্রহণ শেষে রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। সিইসি বলেন, সকালে আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থা দেখেছি। পরে টিভির তথ্য থেকে মনে হয়েছে সহিংসতার মতো গুরুতর ঘটনা ঘটেনি। তারপরও যা ঘটেছে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা গ্রেপ্তার করেছি, মামলা করেছি। শেষ মুহুর্তে দুজন নির্বাচনী কর্মকর্তা মারা গেছেন। হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে তারা মারা যান। সেজন্য তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই।
নির্বাচনী সহিংতায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু কিছু অভিযোগ এসেছে, ব্যালটে সিল মারার। আমাদের মনিটরিং সেল সেটি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আমরা ক্রস চেক করে যখন দেখেছি ঠিক তখন ব্যবস্থা নিয়েছি। শেষ মুহূর্তে একজনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখনও চ‚ড়ান্ত পার্সেন্টিজ হয়নি। তবে আমরা যে তথ্য পেয়েছি তাতে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এন্ট্রি হয়েছে যতটুকু সেটি অনুযায়ী ৪০ শতাংশ। এটি বাড়তে পারে, নাও বাড়তে পারে।
ভোট কম পড়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনে একটি বড় দল নির্বাচন বর্জন করে ভোট থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। সেজন্য ভোট কিছুটা কম পড়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যালটে সিল মেরেছে। আমরা কিছু ধরেছি, সেগুলোকে চূড়ান্ত গণনা থেকে বাদ দেয়া হবে। কারণ সেগুলোর পেছনে সিল বা সাইন নেই। এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.), বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, আনিছুর রহমান, ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানান, বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঢাকায় ২৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২৭ শতাংশ, খুলনায় ৩২ শতাংশ, সিলেটে ২২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৬ শতাংশ, রংপুরে ২৬ শতাংশ ও বরিশালে ৩১ শতাংশ ভোট পড়েছে। তার দুই ঘণ্টা আগে দুপুরের দিকে ইসি সচিব জানিয়েছিলেন, দুপুর ১২টা পর্যন্ত সারা দেশে ১৮ দশমিক ৫০ ভাগ ভোট পড়েছে। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৭ ভাগ, চট্টগ্রামে ২০ ভাগ, সিলেটে ১৮ ভাগ, বরিশালে ২২ ভাগ, খুলনায় ২১ ভাগ, রাজশাহীতে ১৭ ভাগ, ময়মনসিংহতে ২০ ভাগ। গড়ে সারা দেশে ১৮ দশমিক ৫০ ভাগ ভোট পড়ে।
দায় এড়িয়ে গেল ইসি: ভোটার আসা না আসার বিষয়টি ইসির দায়িত্ব নয় বলে দায় এড়িয়ে গেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ভোটারের উপস্থিতি কম নাকি বেশি সেগুলোর আমি কিছুই জানি না। আমি এসে আমার ভোটটা দিয়ে গেলাম। ইসির কাজটা হচ্ছে ভোট আয়োজন করা। কেউ ভোট দিতে আসবেন কি আসবেন না সেটা দেখা আমাদের কাজ নয়। আর নির্বাচনে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সেটা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেখবেন।
নজর রাখা হয় মনিটরিং সেল থেকে: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্থাপিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলে বড় মনিটরসহ সারা দেশের ভোটকেন্দ্রগুলোতে নজর রাখা হয়। গতকাল মনিটরিং সেল ঘুরে ঘুরে সিইসি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নির্বাচনের কেন্দ্রে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন এবং সারাদেশ থেকে আসা অভিযোগগুলো শোনেন। এ সময় মনিটরিং সেলে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আপনারা সার্বিক দিক খেয়াল রাখবেন, কোথাও কোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, নির্দেশনা দেবেন। কাউকে কোনো ছাড় দেবেন না। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সার্বিক ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন।
তিন দেশ থেকে ইসির অ্যাপ হ্যাকের চেষ্টা: এদিকে বিশ্বের তিনটি দেশ থেকে নির্বাচনী অ্যাপ হ্যাক করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম এ বিষয়ে বলেন, তিন দেশ থেকে ইসির অ্যাপ হ্যাকারদের কবলে পড়েছে। এর ফলে নির্বাচনী অ্যাপটি স্লো হয়ে যায়। আমরা সেটি ঠিক করার চেষ্টা করছি। নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি থেকে আমাদের অ্যাপ সেøা করে দিয়েছে। অ্যাপ ছাড়াও আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা আছে। আমরা সেভাবেই সারাদেশের ফলাফল পাচ্ছি।
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্তোষ আওয়ামী লীগে: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টার’ পরও ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। গতকাল রবিবার ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে দলটির দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, বিএনপির নির্বাচনবিরোধী অপপ্রচার, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টার পরও সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক। এটা গণতন্ত্রের জয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন দিয়েছিল, সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে।
বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, কোথাও কোনো কারচুপি নেই, নির্বাচনবিরোধী চক্রের আগাম অভিযোগ সঠিক নয়। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠু সুন্দর হচ্ছে। নির্বাচনের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকা চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শীতের কারণে সকালে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি বাড়ছে। ঢাকার ভোটাররা ছুটি পেয়ে অনেকেই গ্রামে গেছেন, অনেকেই ঘুরতে গেছেন। তাই ঢাকায় ভোটার উপস্থিতি কম।
সংসদ নির্বাচনে গতকাল ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন পুরুষ আর ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন নারী ভোটার। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২। সারা দেশে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ১০৩টি, আর ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি।