বছরজুড়ে সরকারের সমালোচনা শেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। আর চলতি নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীণ খেলায় ক্ষমতা হারিয়েছেন রওশনপন্থিরা। এসব নাটকীয়তার মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে জিএম কাদের ও তার অনুসারীরা।
এদিকে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে রংপুর-৩ আসনে নিজ নির্বাচনী আসনে গণসংযোগ করছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান। এর আগে সম্প্রতি দলীয় বর্ধিত সভায় জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছিলেন, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচনে গেলে জাতীয় পার্টি ‘জাতীয় দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রদূরতের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনে গেলে স্যাংশন আসারও সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর নানা নাটকীয়তা শেষে ২৬ আসনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে ২৫৭ আসনে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করছে জাতীয় পার্টি। সমঝোতার ২৬টি আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে আওয়ামী লীগ। যদিও বেশকিছু আসনে স্বতন্ত্রের আড়ালে আওয়ামী লীগেরই নেতারা প্রতিদ্ব›দ্বী জাতীয় পার্টির। গত এক বছরে জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিভিন্ন ফোরামে দেয়া বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই নিজ অবস্থান থেকে জাপার পল্টি মারার চিত্র উঠে আসে।
গত শনিবার নিজ নির্বাচনি এলাকা রংপুরে গণসংযোগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অনেকদিন পর প্রকাশ্যে এলেন তিনি। সারা বছর সরকারবিরোধী সমালোচনায় থাকা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যান। নির্বাচনের আগে দলের কর্মীসভায় তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্মিলিত মতামত নিয়ে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেন। গেল ১৪ নভেম্বর রাজধানীতে দলের কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভায় তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচনে গেলে জাতীয় পার্টি ‘জাতীয় দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
তার এই বক্তব্যে জাতীয় পার্টি বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাবে না বলেই অনেকে ধারণা করেন। দলীয় নেতাকর্মীরাও সরকার দলের অধীনে কিংবা কোনো ধরনের সমঝোতার নির্বাচনে না যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। গুঞ্জন ওঠে ২০ আগস্ট ভারত সফরে গিয়ে ভারত সরকারের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে এসেছেন জিএম কাদের। দলের শীর্ষ নেতারও বিষয়টি স্বীকার করেন। যা তফসিল ঘোষণার পর দৃশ্যমান হয়।
এ বিষয়ে জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জিএম কাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের কাছে তার অভিমানের কথা তুলে ধরেন। পরে সে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হয় জিএম কাদেরের। এ সমঝোতার কারণে বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ সরকারের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। যার কারণে মনোনয়ন জমা দেয়ার শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে ব্যর্থ হন রওশন এরশাদ। সাক্ষাৎ পান মনোনয়নপত্র প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর। দলীয় নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী বক্তব্য দিলেও জিএম কাদেরের সঙ্গে বিরোধ সরকারের ছিল না। তাকে প্রাধান্য না দিয়ে কেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে সরকার প্রাধান্য দেয়, এটিই তার মূল ক্ষোভ। মূলত এ কারণেই সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়াতে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন জি এম কাদের।
জাপা নেতারা বলছেন, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাননি তিনি।
রংপুরে নিজের নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ শুরু করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে এই প্রথম মুখ খোলেন জাপা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। রয়েছে আর্থিক সংকট। সেই সঙ্গে নির্বাচনে না আসলে দল বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। আর যখন দেখছি, সরকার যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করবে; সেই অবস্থা বিবেচনা করেই আমাদের নির্বাচনে অংশ নেয়া। তবে আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই নির্বাচনে এসেছি। সুষ্ঠু নির্বাচন, অর্থ এবং পেশিশক্তির ব্যবহার যেন না হয় সে সব প্রতিশ্র“তি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দেয়া হয়েছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে জাপা চেয়ারম্যান আরও বলেছিলেন, দলের ভেতর সবসময় একটা অস্থিতিশীলতা ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। যদি তেমন কিছু করতে যাই দল ভেঙে যাবে। দলের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। এ রকম একটা ঝুঁকি সবসময় ছিল। এজন্য আমরা স্বতন্ত্র অবস্থায় থেকে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়েছি। মূলত সংসদে থেকে দেশ ও জাতির জন্য কথা বলা এবং দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। এটা না করলে দলের ঐক্য ধরে রাখা যাবে না।
এছাড়াও তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ বিরাজ করছে। সামনের দিনে কী হতে পারে, সেই কারণে মানুষ উৎকণ্ঠিত। যতই স্বাভাবিক বলা হোক, বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এদিন বেলা ১১টায় দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের কবর জিয়ারত করেন জিএম কাদের। এরপর নগরীরর মুনশিপাড়া কবরস্থানে নিজের মা-বাবার কবর এবং মাওলানা কারামত আলীর জৈনপুরী রহ. এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে তিনি প্রচারণা শুরু করেন। দুদিনের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ঢাকায় ফিরলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ আসনে লাঙলের প্রার্থী জিএম কাদের। এতে ভোটারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
রংপুর ছাড়ার আগে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত ঘরোয়া আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জিএম কাদের। প্রচারণা শেষ হলো কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, আমি একটা দলের প্রধান, দলটা ছোট হলেও সব জায়গায় আমাদের লোকজন আছে। এ নির্বাচন একটা মহাযজ্ঞ, সেখানে বিভিন্ন জায়গার মানুষের বিভিন্ন সমস্যা হয়। তারা আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে চায়। ঢাকায় থাকলে এটা আমার জন্য একটু সহজ হয়, তাদের জন্যও সহজ হয়। তাই আমাকে ঢাকায় কিছুদিন সময় দিতে হবে দলীয় স্বার্থে।
অন্যদিকে দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গী জাতীয় পার্টি (জাপা)। ২০০৯-২০১৪ মহাজোটের শরিক হিসেবে এবং পরবর্তীতে দুই টার্ম সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটি। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে দুই মেয়াদে বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে আছেন। বিরোধীদলীয় উপনেতার চেয়ারে আছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এর মধ্যে গত প্রায় দুই বছর ধরে সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন জিএম কাদের। তার সুরেই কথা বলেছেন পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ আরও কয়েকজন নেতা।
গত ১৭ মার্চ গাজীপুর জেলার চান্দনায় এক জনসভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছিলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেশি আর রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। দেশ এখন দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি। সরকারের রিজার্ভে যে টাকা আছে দেনা তার চেয়ে বেশি। দেনা পরিশোধ করলে রিজার্ভে কোনো টাকা থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের হাতে টাকা নেই, এলসি খুলতে পারছে না। সরকারের হাতে রিজার্ভ নেই। রিজার্ভের টাকা অন্য খাতে খরচ করা হয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
গত ২০ মার্চ কাকরাইলস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, বর্তমান সরকার সকল ক্ষেত্রে দলীয়করণ করে কর্তৃত্ববাদী সরকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট ও প্রশাসনকে সরকারদলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। এমন অবস্থায় বা এমন কাঠামোতে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গত ৫ জুন নবাবগঞ্জে তিনি বলেন, সরকার বিদ্যুৎ দেয়ার নাম করে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র করে মোটা অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের দেয়া হয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট হয়েছে।
গত ১০ জুন রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে জাতীয় যুব সংহতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে জিএম কাদের বলেন, সবার অজান্তেই বাংলাদেশ এখন শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে। আমরা আগেই বলেছিলাম দেশ শ্রীলঙ্কার দিকে যাচ্ছে। তখন শ্রীলঙ্কা তেল ও কয়লা কিনতে পারেনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারেনি। আমদানি করতে পারেনি, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছিল। ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আমরা শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া বলেছিলাম। তখন সারা বিশ্বের মতোই আমরা শ্রীলঙ্কা নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলাম। এখন তো আমাদের অবস্থাও তাই।
গত ১৮ জুন মুন্সীগঞ্জে সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এসে দেশ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। একের পর এক মেগা প্রজেক্ট নেয়া হচ্ছে চুরি করার জন্য। বিদ্যুৎ না থাকায় কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
গত ৩০ জুলাই বগুড়া শহীদ টিটু মিলনায়তনে জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় রাজনীতি এখন সংঘাতময় পরিস্থতিতে চলে গেছে। সরকার গায়ের জোরে সংবিধান সংশোধন করে কতকগুলো আইন করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নিজের কুক্ষিগত করেছে। এর আগে ২৩ জুলাই তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে সবচেয়ে বেশি দুর্বল করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে সমর্থন দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ সবসময় জাতীয় পার্টিতে বিভক্তি সৃষ্টি করে রেখেছে।’
গত ২৩ অক্টোবর বনানী কার্যালয়ে জিএম কাদের বলেন, ক্ষমতাসীন সরকার বলছে; ক্ষমতার বাইরে গেলে তাদের পিটিয়ে মারবে বিএনপি-জামায়াত। আমি বলছি, দল দুটিকে লাগবে না। ১৬ কোটি মানুষকে যেখানে নিয়ে গেছেন, তারা একটি করে ঢিল ছুড়লেই আপনারা শেষ হয়ে যাবেন। গত ১১ নভেম্বর তিনি বলেন, ‘আইন ও সংবিধানের কথা বলে লাভ নেই। আইন ও সংবিধান হয়তো ঠিকই আছে। আমরা রেজাল্ট পাচ্ছি ইলেকশনের না সিলেকশনের। বিভিন্ন সময়ে কতগুলো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে যে তারা চাইলেও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না।’