দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ অসুখেও রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নাম লিখছেন। এতে করে ওষুধ তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে, অন্যদিকে প্রয়োগ বা সেবন করা রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
সম্প্রতি জাতীয়ভাবে পরিচালিত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধবিষয়ক এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার (২২ নভেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
দেশে ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর ওপর চালানো এই সমীক্ষায় ৮২ শতাংশ পর্যন্ত মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া (একাধিক ওষুধরোধী জীবাণু) পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে এটি ছিল ৭১ শতাংশ, ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ৭৪ শতাংশ। এরপর গত তিন বছরে বেড়েছে ৮ শতাংশ।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাধারণ অসুখেও রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নাম লিখছেন।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা না করেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে করা হচ্ছে। এতে অতিমাত্রায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ে কাজে আসছে না। দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ কার্যকর। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করছে না।
গবেষকরা বলছেন, দু-তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া বেশির ভাগই গুরুতর রোগীর ক্ষেত্রে কাজে আসছে না। এ ছাড়া পাইপলাইনে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক নেই। এতে সামান্য অসুখেও রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে অ্যান্টিবায়োটিকের যতযত্র ব্যবহার বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন গবেষকরা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি ৬১ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে হাসপাতালের ভর্তি রোগীর ওপর।
বহির্বিভাগের রোগীর ওপর ব্যবহার ১৩ শতাংশ ও আইসিইউতে ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে ‘সেফট্রিয়াক্সোন’। আইসিইউ রোগীর ক্ষেত্রে এই ওষুধের ব্যবহার ৩৩ শতাংশ, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার ৩৪.৫ শতাংশ এবং বহির্বিভাগের রোগীর ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সেফট্রিয়াক্সোনের কার্যকারিতাও ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। দুজনকে দিলে একজনের কাজ হয়। ফ্লুক্লক্সাসিলিনের অবস্থা আরো খারাপ। অর্থাৎ যে অ্যান্টিবায়োটিক আমরা বেশি ব্যবহার করব, সেটা দ্রুত কার্যকারিতা হারাবে।’
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, দু-একটি ড্রাগ ছাড়া বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক নির্ভরযোগ্য নয়। কোনোটি ৬০ শতাংশ, কোনোটি ৫০ শতাংশ, কোনোটি ৪০ শতাংশ কার্যকর। এ জন্য কালচার অ্যান্ড সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার জরুরি। বেশির ভাগ চিকিৎসক তা করছেন না। সামান্য ভাইরাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৯২৮ সালের প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’ মাত্র ১২ বছরেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিশ্বে ৪২টি অ্যান্টিবায়োটিক এলেও ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এসেছে মাত্র ২১টি। ২০০০ সালের পর নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পরিমাণ একেবারেই কম। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এসেছে মাত্র ছয়টি। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এসেছে ৯টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘আমাদের কোথায় যেন একটা ত্রুটি রয়ে গেছে। এ জন্য গবেষণা প্রয়োজন। সেবাদানকারী ব্যাক্তিদের আচরণের জায়গাটা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা চিকিৎসকরাও কতটা সচেতনভাবে রোগীর ব্যবস্থাপত্র লিখছি, সেটা জানা জরুরি।’
সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন করে মানুষ মারা যাবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে সেপসিসের কারণে প্রতিবছর ৪৭ লাখ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা যায়। প্রতি পাঁচজনে একজন সেপসিসে মারা যাচ্ছে। প্রতি ২.৮ সেকেন্ডে একজন রোগী মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৩৭ শতাংশ মারা যায়। এর কারণ হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। এটি সামনে আরো ভয়াবহ হবে। এ ছাড়া সামনে অসংক্রামক রোগী বাড়ছে। তাদের একটি বড় অংশের সমস্যা হলো ইনফেকশন ডিজিজ। আমরা যদি সতর্ক না হই এবং মৃত্যু কমাতে না পারি, এসডিজি অর্জনে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি অর্জন না-ও হতে পারে।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে যাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষ মারা যাবে উপযুক্ত ওষুধ না পেয়ে। এর মধ্যে কেবল ক্যান্সারেই মারা যাবে ৮২ লাখ, কলেরায় মারা যাবে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার, ডায়াবেটিসে মারা যাবে ১৫ লাখ, ডায়রিয়ায় মারা যাবে এক লাখ ৪০ হাজার, হামে মারা যাবে এক লাখ ৩০ হাজার। সড়ক দুর্ঘটনায় সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক না পেয়ে এক লাখ ২০ হাজার ও টিটেনাসে মারা যাবে ৬০ হাজার মানুষ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটু মিঞা বলেন, ‘আমাদের দেশে কার্যকর ল্যাব বাড়াতে হবে। খামারে পালিত পশুপাখির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশিদ আলম বলেন, ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক হয়ে ওঠা একটি নীরব ঘাতক। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধে যেসব নিয়ম মানা উচিত, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসচিব জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর ও আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন।