মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব

মাতা-পিতা আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ উপহার। শিশুকাল থেকে পরম মায়া মমতায় সন্তানকে লালন পালন করে মাতা-পিতা বড় করেন। নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে সন্তানের আরাম স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির জন্য মাতা-পিতা সারাক্ষণ সচেষ্ট থাকেন।

সন্তানকে ১০ মাস ১০ দিন গর্ভাবস্থায় বহু ধরনের শারীরিক কষ্ট সহ্য করে গর্ভে থাকা সন্তানের স্পন্দন অনুভব করে পুলকিত হতেন মা। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে ভূমিষ্ট সন্তানের মুখ দর্শন করে সকল কষ্ট ভুলে যান মা।  মা সন্তানকে ২ বছর বুকের দুধ পান করান। সন্তানের প্রতি স্নেহ মমতার বশবর্তী হয়ে তার আরামের জন্য সরারাত জেগে কাটিয়ে দেয় মাতা-পিতা। সন্তান অসুস্থ হলে রাতে কান্না করলে নির্ঘুম রাত পার করেন মা। সন্তানের অসুস্থতায় পিতা উন্মাদের মতো হয়ে যান ও নিজের সমস্ত সক্ষমতা দিয়ে সন্তানের চিকিত্সা নিশ্চিত করেন এবং সুস্থ সন্তানের হাসি মুখ দেখে পিতা প্রশান্তি অনুভব করেন। সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে মাতা-পিতার পরম আনন্দের কারণ সন্তানের হাসিমাখা প্রিয় মুখ।

মাতা-পিতা যত অভাব অনটনেই থাকুক না কেন, সন্তানের চিকিৎসা, খাবার ও সন্তানের জন্য সবচেয়ে সুন্দর জামাকাপড় ক্রয় করে পরিতৃপ্ত হন। অনেক অভাবগ্রস্ত মাতা-পিতা নিজেরা না খেয়েও সন্তানের খাবার নিশ্চিত করেন। কিন্তু সন্তানের জন্য তারা সর্বাপেক্ষা উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করেন। মাতা-পিতা তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ ত্যাগ করেন তাদের সন্তানের জন্য। সন্তানের সাথে মাতা-পিতার সম্পর্ক স্বর্গীয়। মহান রাব্বুল আলামিন মাতা-পিতাকে সন্তানের জন্য এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, মাতা-পিতার হূদয় সন্তানের জন্য মায়া, মমতা, ভালোবাসা ও স্নেহে ভরপুর। মাতা-পিতা সন্তানের জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে প্রশান্তি লাভ করেন। সন্তানের শিক্ষার জন্য বহু মাতা-পিতা শারীরিক কষ্ট করে অর্থের জোগান দেন। অথচ সে সকল মাতা-পিতার অনেকের নিজেদের খাবার ও ভালো জামা-কাপড় থঠমশ না। তারা তা সন্তানকে বুঝতে দেন না। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তারা দিবারাত্রি কষ্ট করেন। বর্তমান সমাজে অনেকেই বড় হয়ে মাতা-পিতার এই বিশাল ত্যাগ, পরিশ্রম ও কষ্ট ভুলে যায়। সন্তানের জন্য মাতা-পিতার নির্ঘুম রাত, কষ্ট, যন্ত্রণা, অনাহার সকল ত্যাগ অনেক সন্তান ভুলে যায়।

বিশেষত মাতা-পিতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন অনেক সন্তান মাতা-পিতাকে বোঝা মনে করে। পরিবারে তাদেরকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা ভুলে যায় মায়ের কষ্টের কথা, তারা ভুলে যায় রাতে যখন সন্তান অসুস্থ ছিল-মা তখন সারা রাত সন্তানকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে, কেঁদেছে উত্কণ্ঠায়। সন্তান ভুলে যায়, পিতা সন্তানকে মায়া মমতা ও হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা উজাড় করে লালন পালন করে পরিপূর্ণ মানুষ করেছেন। মাতা-পিতাই পরিপূর্ণ যত্ন, আদর স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে সত্যিকার মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন এবং সন্তান সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সম্মানের পাত্র হয়।

কিন্তু নিজে সমাজ ও রাষ্ট্রে সম্মানিত হয়ে মাতা-পিতাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা শুরু করেন অনেক সন্তান। মহান রাব্বুল আলামিন মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্বের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলে ঘোষণা করেন এবং তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া তোমরা অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন বা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্ত বলোনা এবং তাদের সাথে ধমক দিয়ে কথা বলবে না। তাদের সাথে বিনীত ভাষায় কথা বলবে। তাদের জন্য দয়ার বিছানা বিছিয়ে দিবে আর বলবে- (রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছগিরা) হে আমার রব তাদের প্রতি (মাতা-পিতার প্রতি) এমন রহমত করো, যে ভাবে মমতার সাথে তারা আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমান সমাজে মাতা-পিতা বার্ধক্যে উপনীত হলে, তাদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অনেক সন্তান পালন করেন না। তাদেরকে অবজ্ঞা, অবহেলা করেন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান দ্বারা বয়স্ক মাতা-পিতা লাঞ্ছিত হন, অপমানিত হন ও মানসিক কষ্টে পতিত হন।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন-\’আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছেন। আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও\’ (সুরা লোকমান)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- আমি মানুষকে তাদের মা-বাবার সাথে ইহসান করার আদেশ করেছি” (সুরা আনকাবুত)। মহান রাব্বুল আলামিন মাতা-পিতার প্রতি সদয় হতে সন্তানকে নির্দেশনা দিয়েছেন। মাতা-পিতা সন্তানকে শিশুকালে যেভাবে মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করেছেন, সন্তানকেও বার্ধক্যে মাতা-পিতার প্রতি সে রকম মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন- কোন সন্তান যদি তার মা-বাবার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি নজরে মকবুল হজ লিখে দেন। লোকেরা প্রশ্ন করলো যদি দিনে একশ বার তাকায় তবুও? জবাবে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, আল্লাহ অনেক বড় এবং অতিশয় পবিত্র। এখানে প্রতীয়মান হয় যে মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব পালন, তাদের প্রতি মায়া মমতা ও এহসান করা কর্তব্য ও মহামূল্যবান ইবাদত। অথচ পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমান সময়ে অনেক সন্তান বার বার হজে ও ওমরায় গমন করেন ও নিয়মিত নামাজ রোজা বা অন্যান্য ইবাদত করেন। কিন্তু মাতা-পিতার হক আদায়ে উদাসীন।

নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি অবশ্যই পালন করতে হবে। কিন্তু মাতা-পিতার হক আদায়ে উদাসীন হয়ে মহান আল্লাহর কৃপা লাভ করা অসম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে কঠিন তাগিদ দিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলল্লাহ (স.) বলেছেন- আল্লাহর সন্তুষ্টি মা-বাবার সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে, আর মা-বাবা অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।

মাতা-পিতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তারা শিশুর মতো হয়ে যান। সন্তান যেমন শিশুকালে অসহায় ছিল। সন্তানের কান্না শুনে মা বুঝতে পারতো সন্তানের কি প্রয়োজন। বার্ধক্যে মাতা-পিতাও এমন হয়ে যান, কখনো কখনো তারা শিশু সুলভ আচরণ করেন। কিন্তু তখন তাদের প্রতি রাগান্বিত হওয়া বা রূঢ় আচরণ করা যাবে না। তাদের খাবার ও চিকিত্সার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদেরকে অবজ্ঞা, অবহেলা করা যাবে না। সন্তানের আরাম আয়েশের জন্য যে মাতা-পিতা নিজেদের আরাম বিনষ্ট করে সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে ছিল, সেই মাতা-পিতার কষ্ট লাঘবে সন্তানকেও কষ্ট সহ্য করতে হবে। বার্ধক্যে তাদের শারীরিক সক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে, তখন তাদের অন্যের সাহায্য অতীব প্রয়োজন। তাদের কথা বলা বা গল্প করার কোন লোক থাকে না, ফলে তারা মানসিক যন্ত্রণায় গভীরভাবে আক্রান্ত হন। সন্তান বা সন্তানের স্ত্রী অথবা নাতি নাতনি দ্বারা অবজ্ঞা অবহেলার অনুভব হলে তাদের হূদয় ভেংগে চুরমার হয়ে যায়।

পরিশেষে উল্ল্লেখ্য যে, মা ১০ মাস ১০দিন গর্ভে রেখে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জীবনের সকল সুখ শান্তি ত্যাগ করে সন্তান লালন পালন করেছেন। পিতা নিজের অসচ্ছলতা, অপারগতা ও অক্ষমতা কাটিয়ে সন্তানের জন্য সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। সন্তান বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাতা-পিতার সেবা যত্ন করে এবং বার্ধক্যে মাতা-পিতার খেদমত করে মাতা-পিতাকে হূদয়ের উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে যদি দোয়া নিতে ব্যর্থ হয় ও তার কল্যাণের পথ প্রশস্ত করতে না পারে, তাহলে মহান আল্লাহর রহমত থেকেও তিনি বঞ্চিত হবেন। বার্ধক্যে মাতা-পিতাকে নিজের সন্তান মনে করে পরম মায়া, মমতা ও আদর স্নেহে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে অবশ্যই সে সন্তান পরম সৌভাগ্যবান হবেন ও তার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণের পথ প্রশস্ত হবে এবং ইহকাল ও পরকালে সফল হবেন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে মাতা-পিতার অধিকার আদায়ে সক্ষমতা দান করুন এবং মাতা-পিতার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে তাঁর কৃপা লাভের সুযোগ করে দিন।

 

Scroll to Top