ফাতিমা আমিন
‘ডুব’ রিলিজ হওয়ার একদিন পর আজ তা দেখার সুযোগ ঘটল। ফেসবুকের হট্টগোলে নিরাশ হচ্ছিলাম। কেউ কেউ যে আশার বাণী দিচ্ছিলেন না তা নয়। তবে নানা ফিসফাস শুনতে শুনতে আজ দেখার পর সত্যি সত্যি মনের ভেতর হট্টগোল বেঁধে গেল। ছবিতে কোনো বিপ্লব নেই, বিদ্রোহ নেই। আছে চিরন্তন আড়ালে চলতে থাকা চিরন্তন ভালোবাসার আর্তনাদ। টু বি নোটেড এমন চিরন্তন গল্প হরহামেশাই ফিল্মে দেখে থাকি— সে সকল গল্পের ঝুলিতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ নতুন পালক যোগ করল।
ফারুকী বারবার বলছিলেন এটি কোনো বায়োপিক নয়। চারপাশের মানুষের জীবন থেকে নেওয়া জীবনের গল্প। ফারুকী হুমায়ূন আহমেদের জীবনের গল্প বলেছেন তা জরুরি নয়, জরুরি হলো ফারুকী একটা গল্প বলেছেন যা ভীষণ মানবিক ভালোবাসা আর অসহায়ত্বের মাখামাখি। কাঁটা বিছানো এক জীবন অতল সমুদ্রের মতো বারবার রবীন্দ্রনাথের এই গানের কথা মনে হচ্ছিল—
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে
জীবনের ফুল ফোটা হলে মরণের ফল ফলবে।
ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন ইরফান খান, রোকেয়া প্রাচী, তিশা, পার্নো’সহ অনেকে। সিনেমাটোগ্রাফী এই সিনেমার অন্যতম পলিশ ওয়ার্ক। জাজমেন্টাল হয়ে বলছি না। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি দেখেছি শেখ রাজিবুল ইসলামের। শব্দ নকশাকর রিপন নাথ যথার্থই তার কাজের প্রমাণ দিয়েছেন। মোমিন বিশ্বাসের এডিট- বাহ! আর কোনো শব্দ যোগ নয়। আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে কথা বলতে গেলে ভেবে-চিন্তে বলতে হবে। কিছু কিছু ব্যথা যা নিজে নিজে অনুভব করতে জানতে হয় আমি যেন সেই অভিমান টের পাচ্ছিলাম। আমার নীরব কোন্দলে আর তা ছুঁয়ে গেল গোটা আমাকে, বলে গেল নানা অজানা ব্যথা এই কোলাহল থামবার নয়।
ইরফান খানের গুণমান ব্যাখ্যা করা আমার কম্ম নয়। আমি বাকরুদ্ধ বললেও ভীষণ জীর্ণ শোনাবে। তাকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া কঠিন। ভালোবাসার শেকড় সন্ধানী মানুষটি ভালোবাসা পেয়েছেন আদি থেকে মৃত্যুর পরও। আমার অবশিষ্ট বোধের অঞ্চলে সে রহস্য আলোড়ন তৈরি করে। এত ভালোবাসা পর্দায় অনেকক্ষণ ধরে আবেগের লম্বা লম্বা উপস্থিতি লক্ষ্য করি, আমরা অনুভব করি অনেকগুলো আবেশ ছড়ানো অনুভূতির। আপত্তি কেবল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলায় আর হিন্দি একসেন্টে ইংরেজিতে। যেখানে যেখানে সংলাপ নেই সেখানে ইমোশন দিয়ে বৌদ্ধিক এলাকাগুলোকে আরো স্পষ্ট করেছেন ইরফান। ছবির শুরুতে জাভেদ (ইরফান খান) মেয়ে সাবেরী (তিশাকে) বলল—
‘আমার বাবার মৃত্যু আমাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে তা হলো মানুষ মারা যায় তখনই যখন প্রিয়জনের সঙ্গে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়।’
এই সংলাপের উপলব্ধিই গোটা সিনেমা জুড়ে আমি খুঁজেছি। জাভেদ হাসানের নিমজ্জন আমাকে বার বার ভাবিয়েছে। প্রথম স্ত্রী থেকে অপ্রেম, দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রেম, কন্যা/পুত্রের ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কোথাও কোথাও নৈঃশ্বব্দের হাহাকার। অপ্রেম বার বার বলে ওঠে ‘আহা জীবন জলে ভাসা পদ্ম যেমন’। ছবি নির্মাণ কৌশলে বলার চাইতে না বলার ভাষা এত গভীরভাবে প্রস্ফুটিত তার ব্যাখ্যা বা বিনির্মাণ অত্যন্ত দুষ্কর, বাংলাদেশের দর্শক এখন তার জন্য তৈরি নন আর তাই এতো ফিসফাস।
মায়ার (রোকেয়া প্রচী) নির্বিকার, যোগ বিয়োগ গুন ভাগহীন এক নারী। আমার চারপাশে মায়া’দের এত ভিড় ফলে মায়া’কে বুঝতে আমার এতটুকু বেগ পেতে হয়নি। বিমর্ষ জীবনে আনন্দ কেবল মেয়ে সাবেরীর সাথে, তাও জাভেদের চলে যাবার পর। শক্ত হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা মায়া বুঝতে পারে জীবন বিভাজনে নয়, ভালোবাসায় জীবিত। তাই জাভেদের মৃত্যু তাকে আবার ভালোবাসতে জানান দেয়। ড্রেসিং টেবিলের কোনায় পুনরায় বিয়ের ছবি শোভা পায়। অতীতের চঞ্চল, আবেগী মায়া (কেবল সংলাপে বুঝি) বিষন্নতার ভিড় ঠেলে বাঁচতে শেখে। সাবেরী তার আখ্যানভূমিতে অলংকারের যোগ। স্ত্রী মায়া, মা মায়া ও নারী মায়া ফারুকীর ফ্রেমে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় আমাদের পরিবেশ মণ্ডলে।
সাবেরী (তিশা)টানাপোড়েনের জীবনে দর্শকদের শ্বাস নেবার সুযোগ দেয় না। তিশার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আমার জীবনের নির্মম আবর্তন। দর্শক সারিতে বসা আমি ভিজে উঠি, আমার অতীত জীবনের নির্মম দ্রোহ মন্তাজ হয়ে ফুটে ওঠে। বুকের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসে। কাউকে দেখানো যায় না সে হাহাকার। সে কেবল অনুভবের বিষয়। উচ্ছ্বাস আর বিধ্বংসের দোলাচাল ঘটে সাবেরীর মধ্যে। বাবাকে এত ভালোবাসে যে বাবাকে বড় শাস্তি দিতে কার্পণ্য করে না। মনে হয়—
‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’
শৈশবের বন্ধু বাবার স্ত্রী হয়ে ওঠা মেনে নেওয়া কঠিন, আর তাই এই বিচ্ছেদ। কী বিস্তৃত সে অভিনয় তাকে কেবল খননের সাথেই তুলনা করা যায়। তিশা সাবেরীর জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, থাকতে বাধ্য।
নিতু (পার্ণো মিত্র) খুব অল্প সময় জুড়ে থাকলেও অসাধারণ। ফারুকী না বানিয়ে এই ছবি আমি বানালেও পার্নোর কথাই ভাবতাম, যথার্থ কাস্টিং। পার্নো অনবদ্য, তার নৈপূণ্যে স্বাভাবিকতায়। অতিরিক্ত লাগেনি একবারের জন্যও। সাবেরী আর নিতুর কলেজ রিইউনিয়ন দিয়ে শুরু আর শেষ। নীতু সাবেরীর একই ফ্রেমবন্দি ছবিটি আমার চোখে লেগে আছে সেখানে সংশয়, অস্বস্তি, আড়াল, অস্বাভাবিকতা গল্পের বুক গড়িয়ে আখ্যান রচনা করে। ডুবের ভেতর ডুব দিলে সহজে তার অতল আবিস্কার করা অসম্ভব।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আগের ছবিগুলো নিয়ে আমার অনেক অস্বস্তি আছে সত্য কিন্তু ডুব তার এমনই একটি ছবি যা মনে রাখতে বাধ্য, যা দৃশ্য থেকে দৃশ্যে তার নির্মাণকে মুড়ে রেখেছে আস্তরণে। ফারুকী অস্বস্তির, আশঙ্কার, ক্লেদের, ক্লেশের, আড়ালের এক নিরীহ চারা পূঁতে দিতে সক্ষম হয়েছেন দর্শক দেবালয়ে। সেটাই তার দায়।
আমার গর্ব আমাদের সময়ে আমরা এমন একজন নির্মাতাকে পেয়েছি যিনি এমন একটি ছবি বানিয়েছেন যার মাপকাঠি হয় না। এক নিমিষে আমাদের আড়াল ভুলুন্ঠিত হয় নিকষ গহ্ববরে। ডুব দিয়ে খুঁজতে থাকি আদি থেকে অন্ত, প্রেম থেকে অপ্রেমে। ফারুকী তার দায়িত্ব করেছেন, বাকিটা আমাদের। লোকের নিন্দে যেন আপনাকে না ছোঁই হে নির্মাতা। তাই বলে অসঙ্গতি নেই তা বলছি না। অসঙ্গতি রয়েছে নির্মাতা নিজেও জানেন। সেগুলো আজ বলছি না। আজ কেবল স্তুতি হোক।
চিরকুট অমীমাংসিত প্রশ্নের আকাশে অবেলা বকুলের ন্যায়। প্রাণের কথাটা গেয়ে চলল ছবির গানে গানে এবং তাই যথার্থ। ডুব এর ‘আহারে জীবন’ গানের যে চিত্রায়ন দেখি ইউটিউবের কল্যাণে তাহা এক কথায় অসাধারণ। আমি আপ্লুত। সে গানের নির্মাণ দেখে মনে হয়েছে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর শিল্প মাধ্যমে যা হওয়া উচিৎ, তাই। আর তার সাথে যোগ হলো ‘সুমী’র আবেগে ঠাসা শব্দ বুনট। আহা। শেষ করতে চাই রাহুল সংস্কৃত্বায়নের কবিতা দিয়ে –
অস্থি
তোমার মহিমা জানে পঙ্গু লোকালয়
যেহেতু বিগ্রহ তুমি, আলোড়ন কেন্দ্র তুমি
আমরা আড়াল হতে দেখি কিভাবে তোমার আঁখি
নীল থেকে আরও নীল অতি নীল
এবং মুগ্ধতা হেতু ইদানিং টের পাই
কাহাকে বশ্যতা বলে, কাকে বলে প্রতিক্রিয়া
মিনতি করি ‘ডুব’ নিয়ে কোনো অভিঘাত নয়। এ এক ভালোবাসায় বাঁচতে চাওয়া অবশেষ। সিনেমা ভাষার বদল ঘটিয়ে নতুন এক ভাষার জন্ম দিয়েছেন ফারুকী আর তাতে লেখক আপ্লুত। আর লেখার মাধ্যমে আমি আমার ভালোবাসা পৌঁছে দিতে চাই। এই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তাই এই আপ্তবাক্যে লেখলাম ফারুকীর জন্য চণ্ডিমঙ্গল।
জয়তু সিনেমা
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী, একাত্তর মিডিয়া লিমিটেড
বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, ৩০ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/সাদ