রাজশাহীর হোটেল নাইসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই প্রেমিক-প্রেমিকা খুনের দেড় বছর পর ধর্ষণ ও খুনের জট খুলেছে। পুলিশের তদন্তে প্রেমিকা ধর্ষণের পর প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে বলে প্রতিবেদন দেয়াও হয়। তবে শুরু থেকে তদন্ত এবং হত্যার মোটিভ নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছিলো। ঘটনাস্থল থেকে ৩টি ব্যান্ডের সিগারেটের টুকরো (শেষ অংশ) পাওয়া গেলেও পুলিশ তা গুরুত্ব দেয়নি। সে সময় সংবাদ সম্মেলনে, ভিকটিমরা নিজেরাই হোটেল বয়কে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বলে জানান মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার নাহিদুল ইসলাম নাহিদ। গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি পুলিশ পরিদর্শক মামলাটি তদন্ত শেষে সুমাইয়াকে ধর্ষণের পরে হত্যা করে মিজানুর নিজেই আত্মহত্যা করেছেন বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এদিকে পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সে তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিশোধ নিতে চার বন্ধু প্রেমিককে হত্যার পর তরুণীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করে। এক্ষেত্রে হত্যাকারীরা হোটেল বয়ের সাহায্য নেয়। প্রথমে হত্যাকারীরা হোটেল নাইসের পাশের তিনতলা একটি মার্কেটের ছাদে ওঠে। সেখান থেকে হোটেল বয়ের সাহায্যে জানালা দিয়ে ৩০৩ নম্বর কক্ষে ঢোকে হত্যা ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করে এসব তথ্য পেয়েছে। যাদের মধ্যে দুজন রাজশাহীর মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন।
জানা গেছে, গত বছরের ২২শে এপ্রিল রাজশাহীর হোটেল নাইসে একটি কক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান মিজান ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিজানুরের লাশ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো ছিল। আর সুমাইয়ার লাশ বিছানায় পড়েছিল। ঘটনার পরের দিন ২২ এপ্রিল সুমাইয়ার বাবা আব্দুল করিম বাদী হয়ে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। এতে তরুণীকে ধর্ষণের পর তরুণ-তরুণী দুজনকেই হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় হত্যার অভিযোগ করা হয়। অবশেষে খুনের অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এই জোড়া খুনের রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। গ্রেপ্তারকৃত চারজন হলেন- রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ, রাজশাহী কলেজের ছাত্র আল আমিন ও বোরহান কবির উৎস।
এদের মধ্যে রনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার এনামুল হক সরদারের ছেলে। রাহাতের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খোর্দ্দ গজাইদ গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে। আর আল আমিন রাজশাহীর পবা উপজেলার জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের টিপু সুলতানের ছেলে এবং উৎস নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামের শফিউল কালামের ছেলে। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার চার জনের মধ্যে রনি ও উৎস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছেন। আর রাহাত ও আল আমিনকে আবারো রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।
মহিদুল বলেন, আহসান হাবিব রনি রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র হলেও ঘটনার পর থেকে সে ঢাকায় অবস্থান করছিল। গত ১৮ই অক্টোবর তাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার দিন নিহত মিজানুর ও রনির একটি ফোন কলের সূত্র ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এর পরের দিন তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহী নগরীর একটি ছাত্রাবাস ও সোনাদিঘী এলাকা থেকে রাহাত মাহমুদ, আল আমিন ও উৎস এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০শে অক্টোবর তাদের আদালতে হাজির করা হলে রনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। অপর তিনজনকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২৩শে অক্টোবর তাদের তিনজনকে আদালতে হাজির করা হলে উৎস ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও দুইজনকে হত্যার কথা স্বীকার করে। রাজশাহী মহানগর হাকিম জাহিদুল ইসলাম ও কুদরাত-ই-খোদা যথাক্রমে রনি ও উৎসের জবানবান্দি রেকর্ড করেন।
রনি স্বীকার করেন, হোটেল কক্ষে মিজানুরকে প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এর পর তারা সমুাইয়াকে সবাই মিলে ধর্ষণ করেন। পুলিশের মেয়ে বলে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা তাকেও মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে।
জবানবন্দিতে রনি আরও বলেন, রাহাত মাহমুদের সঙ্গে প্রথমে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুরের সঙ্গে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ নিয়ে রাহাত তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে। রাহাত নগরীর বিনোদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকতো। সেখানে তিনি আহসান হাবিবকে ডেকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলেন। মিজানুরের সঙ্গে প্রেমের সর্ম্পকের কথা শুনে আহসান হাবিব বলেন, মিজানুরকে তিনি চেনেন; সে ল্যাংড়া।
এরই মধ্যে মিজানুরের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুমাইয়া রাজশাহীতে আসছিলেন। মিজানুর তাকে নাটোরের বনপাড়া থেকে এগিয়ে নিয়ে আসেন। সে সময় মিজানুর আহসান হাবিবকে ফোন করে জানতে চান শহরের কোন হোটেলে উঠলে ভালো হয়। আহসান হাবিব তাকে হোটেল নাইসে উঠার পরামর্শ দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১শে এপ্রিল রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে হোটেল কক্ষে তারা মিজানুর ও সুমাইয়াকে হত্যা করে।
আদালতে আহসান হাবিব রনি বলেছে, হোটেলের ওই কক্ষে ঢুকে তারা প্রথমে শুধু সুমাইয়াকে পান। তারপর তারা মিজানুরকে ফোন করে ডাকার জন্য সুমাইয়াকে চাপ দেন। বাধ্য হয়ে সুমাইয়া মিজানুরকে ফোন করে ডাকেন। জবানবন্দিতে উৎস বলে, পাশের ভবনে এসির উপর দিয়ে গিয়ে তারা জানালা দিয়ে সুমাইয়ার রুমে প্রবেশ করে। মিজান রুমে আসার পর তার সঙ্গে রাহাতের কথা কাটাকাটি হয়। এর এক পর্যায়ে রাহাত টি টেবিলের পায়া খুলে মিজানের মাথায় আঘাত করে। এতে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। এর পর সুমাইয়ার ওড়না দিয়ে গালায় ফাঁস দিয়ে রাহাত ও রনি মিজানকে হত্যা করে। তারপর লাশ মেঝেতে রেখে প্রথমে রাহাত, এরপর রনি তারপর আল আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এ সময় মেয়েটি শুধু কাঁদছিল। ধর্ষণের পর রনি সুমাইয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে। এতে সে ব্যর্থ হলে রাহাত ও রনি দুইজনে মিলে সুমাইয়ার মুখে বালিশ চেপে ধরে হত্যা করে। এর পর মিজানের লাশ রনি ও রাহাত ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। ঘটনার সময় রাহাত ও রনি একাধিক সিগারেট খায়। এর পর রনি দরজা দিয়ে এবং অন্যরা জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, ২৮ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি