ফারসি শব্দ থেকে এসেছে ‘শবে বরাত’। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত। ইসলামে এই রাত বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। শিরক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সবারই ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এই রাতে। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তার সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)
হাদিসের বর্ণনামতে, মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারীরা এই রাতে ক্ষমা পাবে না। তাই এই রাতের ফজিলত লাভের জন্য প্রথমে অতীতের সব গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিক তওবা করা উচিত হবে। একইসঙ্গে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এছাড়াও এই রাতে আরও কিছু দোয়া করা যায়। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার দোয়া
শবে বরাতে এই দোয়াটি পাঠ করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এই রাতে আল্লাহ তাআলার ক্ষমা পেতে হলে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তাই যেকোনো মর্যাদাপূর্ণ রাতে নিচের দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার দোয়াটি হলো- رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِىْ قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ উচ্চারণ: রব্বানাগফির লানা- ওয়া লিইখ্ওয়া-নিনাল্লাযীনা সাবাকূনা- বিল ঈমা-নি ওয়ালা- তাজ‘আল ফী কুলূবিনা- গিল্লাল লিল্লাযীনা আ-মানূ রব্বানা- ইন্নাকা রাঊফুর রহীম। অর্থ: ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও আমাদের পূর্ববর্তী ভাইয়েরা যারা ঈমান এনেছে তাদের ক্ষমা কর, ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ালু পরম করুণাময়’। (সুরা হাশর: ১০)
শিরক থেকে মুক্ত থাকার দোয়া
আল্লাহর কাছে যেকোনো দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত শিরক থেকে বেঁচে থাকা। আর শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করতে হয়। রাসুল (স.) সেই উপায় শিখিয়ে দিয়েছেন। মা’কাল ইবনু ইয়াসার (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) আবু বকর (রা.)-কে বলেছেন, ‘হে আবু বকর! নিশ্চয় তোমাদের মাঝে শিরক পিপীলিকার পদধ্বনির চেয়ে সূক্ষ্ম। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, শিরক পিপীলিকার পদধ্বনির চেয়ে সূক্ষ্ম। আমি কি তোমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দেব না, যা বললে শিরকের অল্প ও বেশি সবই দূর হয়ে যাবে? আপনি বলুন— ااَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ اَنْ أشْرِكَ بِكَ وَاَنَا أَعْلَمُ وَاَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা আন-আশরিকা বিকা, ওয়া আনা আ’লামু; ওয়া আসতাগফিরুকা লিমা লা আ’লামু।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি সজ্ঞানে তোমার সঙ্গে শিরক করা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই এবং যা আমার অজ্ঞাত তা থেকেও তোমার কাছে ক্ষমা চাই।’ (সহিহ আল আদাবুল মুফরাদ: ৫৫১)
রমজান পূর্ববর্তী বিশেষ দোয়া
রমজানের দুই মাস আগ থেকেই রাসুল (স.) উম্মতকে একটি দোয়া বেশি বেশি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দোয়াটি আমরা পুরো রজব-শাবানে তো পড়বোই। আজ শবে বরাতের রাতেও আমরা দোয়াটি পড়ব ইনশাআল্লাহ। দোয়াটি হলো— اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (বায়হাকি: ৩৫৩৪; নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬)
মা-বাবাসহ সকল মুসলমানের জন্য দোয়া
হিংসুক কখনও অন্যের জন্য দোয়া করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত মুমিনরা পৃথিবীর সব মুসলমানকে মনে-প্রাণে ভাই মনে করেন এবং সবার জন্য দোয়া করেন। পবিত্র কোরআনে জীবিত-মৃত সব মুসলমানের জন্য দোয়ার শিক্ষা রয়েছে। তেমনই একটি দোয়া হলো— ‘রব্বানাগ-ফিরলি ওয়ালি ওয়ালি-দাইয়্যা ওয়ালিল মু’মিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’ অর্থ: ‘হে আমাদের রব! আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং সব ঈমানদারকে আপনি সেই দিন ক্ষমা করে দিন, যেদিন হিসাব কায়েম করা হবে।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪১)
জীবিত-মৃত পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য দোয়া করার আরো উপকার আছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, প্রত্যেক মুসলমানের বিপরীতে একটি করে সওয়াব মহান আল্লাহ তার আমলনামায় লিখে দেন।’ (তাবরানি: ৩/২৩৪)
আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের দোয়া
শবে বরাত আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভের রাত। এই রাতে আল্লার অনুগ্রহ চেয়ে এই দোয়া পড়া যায় رَبِّ أَوْزِعْنِىٓ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِىٓ أَنْعَمْتَ عَلَىَّ وَعَلٰى وٰلِدَىَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صٰلِحًا تَرْضٰىهُ وَأَدْخِلْنِى بِرَحْمَتِكَ فِى عِبَادِكَ الصّٰلِحِينَ উচ্চারণ: রাব্বি আওঝি’নি আন আশকুরা নি’মাতাকাল্লাতি আনআমতা আলাইয়্যা ওয়া আলা ওয়ালিদাইয়্যা ওয়া আন আ’মালা সালেহাং তারদাহু ওয়া আদখিলনি বিরাহমাতিকা ফি ইবাদিকাস সালিহিন। অর্থ: ‘হে আমার রব, তুমি আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছ তার জন্য আমাকে তোমার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দাও। আর আমি যাতে এমন সৎকাজ করতে পারি যা তুমি পছন্দ করো। আর তোমার অনুগ্রহে তুমি আমাকে তোমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো’। (সুরা নামল: ১৯)
ঋণ, দুশ্চিন্তা, ভয় ও দমন-পীড়ন থেকে মুক্তির দোয়া
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আ‘উযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিনাল-‘আজযি ওয়াল-কাসালি, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিনাল-বুখলি ওয়াল-জুবনি, ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন দ্বালা‘য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজা-ল। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।’ (বুখারি: ২৮৯৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শবে বরাতের এই রাতে উল্লেখিত দোয়াগুলো বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।