ঢাকার রাস্তায় চলতে গেলে বায়ুদূষণের কারণে দম বন্ধ হয়ে আসে। যারা প্রাইভেট পরিবহনে চলেন তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারে হেঁটে চলেন বা লোকাল বাসে চলেন তারা বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হন বেশি। নিঃশ্বাস নেওয়া খুবই কষ্টকর হয়ে যায়।
চিকিৎসকরা সে কারণে সব সময় মাস্ক পরার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৪০ বছর বয়সী এক কর্মকর্তা প্রায় ১০ বছর ধরে খুসখুসে কাশিতে ভোগছিলেন, কিন্তু এখন তার আর সেই ধরনের কাশি নেই।
তার কাছ থেকে জানা যায়, ১০ বছর আগেই ডাক্তার তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাসার বাইরে বের হলে নিয়মিত মাস্ক পরতে কিন্তু তখন তিনি সেই পরামর্শ যথাযথভাবে পালন করেননি। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি মাস্ক ব্যবহারে সিরিয়াস হন, আর কোনো চিকিৎসা ছাড়াই তিনি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন। অর্থাৎ দূষিত বায়ু থেকে তিনি নিজেকে সেইভ করার পর আর সমস্যায় পড়েননি।
বাংলাদেশের দূষণ-প্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্ণতায় ভুগছেন বলে বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় উঠে এসেছে; যা কম দূষণ আক্রান্ত এলাকার চাইতে বেশি। তবে বায়ুদূষণের এই দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক প্রভাবের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এর আগেও বায়ুর মানের সূচকে বাংলাদেশ বিশেষত ঢাকা শহর কয়েক দফা সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে উঠে এসেছে।
জানা গেছে, গত ২১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ৩০৮। অর্থাৎ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা আবারও বিশ্ব দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে। ভারতের কলকাতা ও দিল্লি যথাক্রমে ২৩২ ও ২২৫ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার পরবর্তী দুইটি স্থানে রয়েছে। একিউআই স্কোর ১০১ থেকে ২০০ পর্যন্ত “অস্বাস্থ্যকর” হিসেবে বিবেচিত হয় বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য।
একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। এই অতিরিক্ত বায়ুদূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর।
বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) জরিপে সম্প্রতি এ তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যাপসের গবেষণায় অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলাদেশের ১৮টি জেলাকে। সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে গাজীপুরে, এরপরই রয়েছে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ; যেখানে বায়ুতে অতি ক্ষুদ্রকণার মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শ মান প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চাইতে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।
আর বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যে অতি ক্ষুদ্র কণা সেটি আদর্শ মাত্রায় আছে কেবল ১০টি জেলায়। সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারীপুর, পটুয়াখালী ও মেহেরপুরে। এই অতি ক্ষুদ্রকণা বলতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের বস্তুকণার কথা বলা হচ্ছে।
ক্যাপসের ৮১ সদস্যের একটি গবেষক দল দেশটির ৬৪ জেলার তিন হাজারের বেশি স্থানের বায়ুর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মান পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। তারা এসব জেলার প্রতিটিতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের ধূলিকণার ব্যাপকতা পরিমাপ করেছেন। একটি চুলের সাথে তুলনা করলে এসব ধূলিকণার আকার চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান; যা সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে।
গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে বলা হয়েছে যে, বায়ুদূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। এছাড়া বায়ুদূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পুরো প্রাণীজগতের ওপর পড়ছে বলে জানা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ১৫ দফা সুপারিশ করেছেন গবেষকেরা। এর মধ্যে রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়া, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে। এছাড়া গাছ লাগানো, ছাদ বাগানে উৎসাহিত করা, জলাধার সংরক্ষণ সেইসাথে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাজেটের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তথ্য সূত্রঃ (আংশিক) হাসান আল বান্না