ব্যাংকে টাকা নেই এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকহারে। এই গুজবে অনেকেই তুলে নিয়েছেন ব্যাংকে জমা রাখা অর্থ। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে তুলে নেওয়া অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের প্রতি কেন এই আস্থার সংকট তৈরি হলো?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক যুগ আগে দুষ্কৃতকারী গ্রাহকরা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নিত।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা (উদ্যোক্তা ও পরিচালক) নামে-বেনামে ঋণের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় কিছুটা হলেও আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের যে কোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ থাকলে আস্থার সংকট হবে না। তবে জনগণের অর্থ নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে ব্যাংকের বিকল্প নেই।
রাজনীতির ধরন বিবেচনায় ২০১৭ সালে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আসে। এর কিছুদিন পর আরেক ইসলামী ধারার এসআইবিএল ব্যাংকেরও পরিবর্তন ঘটে। এই ব্যাংক দুটির মালিকানা তুলে দেওয়া হয় চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলমের হাতে। ওই গ্রুপটির মালিকানায় বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৮টি।
রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী গ্রুপটি ব্যাংক দখলের পর থেকেই ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এরপর থেকেই গ্রাহকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাংকে টাকা নেই। এতে অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নিচ্ছেন।
টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই, এটা বলার পর সত্যিকারের একটা ইমপ্যাক্ট হয়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মানুষ উইথড্র করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু তাতে বাধা দেয়নি। এখন সবাই টের পেয়েছে, আরে! এটা তো ভুল করেছি। এখন সবাই টাকা ফেরত দিতে শুরু করেছে। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন। এখন কিন্তু সবাই আবার ফেরত দিচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, মানুষ আগের তুলনায় বেশি করে নিজের কাছে নগদ টাকা রাখছে। এটি শুধু গুজবের কারণে নয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এজন্য অনেকেই জমানো টাকা তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে মুদ্রা ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। বাংলাদেশে সরকারি মুদ্রা হলো ১, ২ ও ৫ টাকার নোট এবং কয়েন। সরকারের ইস্যুকৃত এ ধরনের মুদ্রা রয়েছে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ও গভর্নরের স্বাক্ষরযুক্ত নোট ব্যাংক নোট হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক নোট হলো ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার কাগুজে মুদ্রা।
অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বাংলাদেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ১০-১২ শতাংশ নগদ হিসেবে বাজারে থাকাই যথোপযুক্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে প্রতিবছরই ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে এসে এ অর্থের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
তবে ওই বছরও ব্যাংক খাতের মোট আমানতের সাড়ে ১৩ শতাংশ নগদে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা। নগদ এ অর্থের প্রায় ৯৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই ব্যাংকের বাইরে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ছাপানো মুদ্রার পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনগণের হাতে নগদ অর্থ রয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছাপানো মুদ্রার ৯২ শতাংশই মানুষের নগদ রয়েছে। সেপ্টেম্বরে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এটি বেড়েছিল ১১ শতাংশ। চলতি বছরের জুনে বেড়েছিল ১৩ শতাংশ আর গত বছরের জুনে বেড়েছিল ৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় মানুষ ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিলে তা কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকেই ফেরত আসে। ক্রেতা-বিক্রেতার মাধ্যমে লেনদেন হয়ে ব্যাংকের ভল্টেই আশ্রয় নেয় টাকার নোটগুলো। কিন্তু আস্থাহীনতার কারণে কোনো অর্থ তুলে নিলে সেটি আর ব্যয় হয় না। মানুষ তার নিজের কাছে টাকা রেখে দিচ্ছে।
এতে ব্যাংক থেকে অর্থ বেরিয়ে গিয়ে অর্থনীতির চক্র থেকেই অর্থগুলো গায়েব হয়ে যাচ্ছে। আস্থাহীনতার কারণে বেরিয়ে যাওয়া অর্থ ব্যাংকে ফেরত আসতে সময় লাগতে পারে। এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। কোনো কারণে ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে অসমর্থ হলে আস্থাহীনতা প্রকট আকার ধারণ করবে।
গ্রাহকদের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার মূল কারণ ইসলামী ধারার তিন ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের জেরে। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ইসলামী ব্যাংক রাষ্ট্রীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যারা এ ব্যাংকে আমানত রেখেছেন, তাদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। তবে বাজারে অনেক গুজব আছে, সেখানে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে কিনা তার তদন্ত চলছে। তদন্তের পরই আমরা বলতে পারব।
বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে একটা অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ না হলেও ব্যাংকের প্রতি অনাস্থার অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংকট আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি। ঋণ খেলাপি বড় সমস্যা। ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া, অনিয়মের মাধ্যমে টাকা নেওয়া এবং সেটির পরে কোনো হদিস পাওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক যাদের এই বিষয়গুলো দেখার কথা তারা সঠিকভাবে দেখছে না। বেসিক ব্যাংকের ঘটনা ১০ বছর হয়ে গেলও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যারা যত প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে পরিস্থিতির উত্তরণ করা সম্ভব।
সংবাদ সূত্রঃ সাম্প্রতিক দেশকাল