ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মধ্যে দেশের ১৭ জেলায় গাছ ভেঙে পড়ে, দেয়াল ধসে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং পানিতে ডুবে অন্তত ৩৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিক, ভোলায় ৪ জন, কুমিল্লায় একই পরিবারের ৩ জন, টাঙ্গাইলেন ৩ জন, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জ সিরাজগঞ্জ, ও মুন্সীগঞ্জে ২ জন করে, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, নড়াইলের লোহাগড়া, বরগুনা সদর, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, কক্সবাজার, গাজীপুর, ঢাকার হাজারীবাগ এবং শরীয়তপুরের জাজিরায় একজন করে। এ সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে ৮ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গতকাল সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকেরা হলেন ইমাম মোল্লা, মাহমুদ মোল্লা, শাহীন মোল্লা, আল আমিন, মো. তারেক ও বাশার। অন্য দুজনের নাম জানা যায়নি। তবে ড্রেজারটি থেকে এক শ্রমিক তীরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। ওই শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়। মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুর রহমান জানান, লাশ উদ্ধারে সাগরে ডুবুরি ও ফায়ার সার্ভিস দল কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় গাউসিয়া কমিটির মানবিক টিমের সহায়তায় উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের কদমরসুল আছোয়া শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর লাশটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এখন পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ঝড়ের মধ্যে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার দৌলতখান, চরফ্যাশন ও সদর উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া লালমোহনে জোয়ারের পানিতে ডুবে এক নারীর মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। নিহতরা হলেন, দৌলতখান পৌরসভায় মৃত গোলাম মোস্তফার স্ত্রী বিবি খাদিজা (৮০), চরফ্যাশনের উপজেলার এওয়াজপুর এলাকার বাসিন্দা আলম স্বর্ণকার, ভোলা সদরের মফিজল হক (৬২) ও লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ফাতেমাবাদ গ্রামে রাবেয়া বেগম (২৫)
ঝড়ের মধ্যে রাত ১১টার দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়নের হেসাখাল পশ্চিম পাড়ায় গাছ ভেঙে ঘরের উপর পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- হেসাখাল পশ্চিম পাড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার সাথী এবং তাদের মেয়ে চার বছরের শিশু নুসরাত আক্তার লিজা। হেসাখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল বাহার বলেন, বাতাসে একটি গাছ উপড়ে তাদের ঘরের ওপর পড়ে। পরে ভেতর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি ও প্রবল বাতাসে গাছ ভেঙে বসতঘরের ওপর পড়ায় মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। নিহত মা আসমা বেগম আশু (২৮) এবং মেয়ে সুরাইয়ার (৩) লাশ মঙ্গলবার সকালে স্থানীয়রা চাপাপড়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় একই পরিবারের বাবা ও ছেলে গুরুতর আহত হয়েছেন। লৌহজং থানার ওসি আব্দুল্লা আল তায়েবীর জানান, সোমবার দিনগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
ঝড়ের মধ্যে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাঁচ কাহনীয়া ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামে গাছ চাপা পড়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন–পাঁচ কাহনীয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) এবং বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রুমিছা বেগম (৬৫)। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, ঝড়ের সময় শারমিন বেগম ঘরের বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি গাছ ভেঙে ঘরের বারান্দায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আর রুমিছা বেগমের বাড়িতে যখন গাছ ভেঙে ঘরে পড়ে, তিনি তখন ঘরে শুয়ে ছিলেন। তিনিও ঘটনাস্থলে মারা যান।
সিরাজগঞ্জ সদরে যমুনা নদীর একটি খালে নৌকা ডুবে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহন ও শিল্পপার্কের মাঝামাঝি এলাকার খালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বৈঠাচালিত নৌকাটি শিল্পপার্ক থেকে পূর্বমোহনপুরে যাচ্ছিল। মৃত দুজন হলেন– উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ঝড়ের মধ্যে নোঙ্গর করা ইটভর্তি একটি ট্রলারও পানিতে ডুবে এক শিশুসহ দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, সদর উপজেলার লোহালিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরপুর গ্রামের রশিদ মোল্লার ছেলে নূর ইসলাম (৪০) ও কুয়াকাটায় উপজেলার ওবায়দুল্লাহ দোভাষীপাড়া গ্রামের মো. ইব্রাহিমের ছেলে ওবায়দুল্লাহ।
ঘূর্ণিঝড় উপকূলে পৌঁছানোর আগেই দুপুরে ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে বলে লোহাগড়া থানার ওসি মো. নাসির উদ্দীন জানান। নিহত মর্জিনা বেগম (৪০) বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামের বাসিন্দা।
বরগুনা সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে গাছের নিচে চাপা পড়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। মৃত বৃদ্ধার নাম আমেনা খাতুন। গতকাল সোমবার রাত সাড় ৮টার দিকে উপজেলার ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সোনাখালী বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাওসার হোসেন জানান।
সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে ঢাকার হাজারীবাগে দেয়াল ধসে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় জিগাতলার মনেশ্বর রোডে এ ঘটনায় আহত হয়েছেন এক মোটর সাইকেল চালক।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় ঘরের ওপর গাছ পড়ে স্নেহা নামে ১১ মাসের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন তার মা সানজিদ ফাতেমা নুর স্মৃতি (২৫)। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ৩টায় উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের হাবিবিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্নেহা ওই গ্রামের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আবদুল্লার মেয়ে।
কসবা উপজেলায় ঝড়ের সময় ঘরের উপর গাছ পড়ে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন তার স্ত্রী। নিহত জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া (২৬) কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের ধ্বজনগর গ্রামের মৃত সিরাজ মিয়ার ছেলে।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কাপাসিয়ার ইউএনও এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাটির ঘর ধসে গিয়ে পাশের টিনের ঘরকে চাপা দেয়। এতে ওই ঘরে থাকা শিশু আনিসুরের মৃত্যু হয়।
কক্সবাজারের ঝড়ের সময় নিখোঁজ এক শিশুর লাশ পরে টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সোহেনা (৯) নামের শিশুটি টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলমের মেয়ে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
শরীয়তপুরে গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার জাজিরা উপজেলার সিডারচর এলাকার হালান মুসল্লির স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সাফিয়ার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মৃত্যুটা এড়ানো যেত।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমীন বলেন, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।পথে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসটি রাত সাড়ে আটটার দিকে গোলাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন।