ধবধবে সাদা বিশাল বড় হাবেলির সামনে শুয়ে আছেন ঠাকুর সাহেব। পরনে তার কুর্তা আর ধুতি, গলায় ঝোলানো মোটাসোটা স্বর্ণের চেইনের সাথে হনুমানের পেন্ডেন্টটা চোখে পড়ছে খুব। ভীষণ রকম কাশছেন তিনি। কাশির সাথে হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে বুক। আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন বেশ কিছু ভারিক্কী চেহারার লোক, সবার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। শেষ সময় এসে গেছে ঠাকুর সাহেবের।
এতোগুলো পরপুরুষের সামনে বের হতে পারছে না বাড়ির মেয়েরা, শেষবারের মতো প্রিয় মুখটা একবার দেখার সুযোগও পাচ্ছে না তারা। এমন করুণ পরিবেশেও বৈষয়িক আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হয়ে উঠলেন দু-একজন, তাদের প্রধান চিন্তা ঠাকুর মারা গেলে ঐ অঞ্চলের দেখভাল কে করবে? আর ঠাকুর তার পাপ-পুণ্যের হিসেবে নরকের আগুন থেকে রেহাই পাবেন তো?
এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন ঠাকুর, “কী শুরু করলি তোরা! শান্তিতে মরতে দিবি না আমাকে? আমি মরে গেলে তো কান্নাকাটি করার জন্য একটা লোকও কোথাও নেই দেখছি!” উত্তর যেন তৈরিই ছিল, “কেন অযথা চিন্তা করছেন ঠাকুর? রুদালি তো সেই কখন থেকে বসে আছে আপনি মারা গেলে কাঁদতে বসবে বলে!” না, কোনো সিনেমার দৃশ্য নয় এটি, বাস্তবেও ঠিক এমনটাই ঘটতো, বলা ভালো ঘটে চলেছে রাজস্থানে। জীবনের এই কঠিন সত্য অবলম্বনে বরং নির্মিত হয়েছে ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত, কল্পনা লাজমী পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রুদালি’।
কালো পোশাক পরিহিত একঝাঁক নারী ঘুরে বেড়াত রাজস্থানময়। কোথাও কেউ মারা গেলে বা মারা যাবে এমন সম্ভাবনা থাকলে আগে থেকে ভাড়া করে রাখা হতো তাদের। তাদের প্রধান কাজ মরা বাড়িতে গিয়ে মাতম করা, বুক চাপড়ে কাঁদা, গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে দেয়া। ভুল করেও সে চোখের পানির একটি কণাও মুছত না তারা, এই প্রথম কারো মৃত্যুতে কাঁদছে না তারা, শেষ কান্নাও নয় এটি। গোটা বাড়িতে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি করতেই তো তাদের ভাড়া করে আনা! এই প্রথা চলেছে শত শত বছর, এখনো চলছে রাজস্থানের বিভিন্ন অজপাড়াগাঁয়ে।
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে শোকের মাতম করা এই নারীরা সাধারণভাবে পরিচিত ‘রুদালি’ নামে। তাদেরকে বলা হয় ‘প্রফেশনাল মৌনার’ বা পেশাদার বিলাপকারী। বিলাপ করেই জীবিকা নির্বাহ করে তারা। পরনে থাকে কালো পোশাক, যমের পছন্দের রঙ নাকি কালো। তাই মৃত্যুদূতকে খুশি করতে তার পছন্দের সাজেই নিজেদের সজ্জিত করে তারা।
সমাজের একেবারে নিচু জাত থেকে তুলে আনা এই রুদালিদের বেশ কিছু সমাজে বিয়ে করারও নিয়ম নেই। নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে লোকের মৃত্যুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁদবে কে? চেনা নেই, জানা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই; কেবল অর্থের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে লোক দেখিয়ে কাঁদার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে তাদের।
রুদালিদের এই পেশা আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হতেই পারে, কিন্তু রাজস্থানের পশ্চাৎপদ কিছু জনগোষ্ঠীর কাছে এটিই স্বাভাবিক, নির্মম সত্য। তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে রুদালিদের অস্তিত্ব। সমাজের উচ্চশ্রেণীর নারীরা অর্থাৎ জমিদার বা ঠাকুর কন্যারা, বাড়ির বউরা বাইরের লোকের সামনে কাঁদবে বা নিজেদের আবেগ প্রকাশ করবে, সে আবার কেমন কথা?
কাজেই তারা হাবেলির অন্দরমহলে বন্দী থেকে, লম্বা ঘোমটার আড়ালে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলুক আর না ফেলুক তাতে মৃত ব্যক্তির কিছু আসে যায় না। কিন্তু সমাজের সামনে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি জাহির করতে গেলেও তো মরার সময় কান্নাকাটি করার জন্য কয়েকজন লোক লাগে। বড়লোকের সেই চাহিদা থেকে জন্ম নেয়া একটি সমাজের নাম ‘রুদালি’।
কলকাতার সাংবাদিক এবং লেখক নিধি দুগার কুন্দালিয়া তার ‘দ্য লস্ট জেনারেশন’ বইটিতে প্রায় বিলুপ্ত কিছু প্রথা বা পেশার কথা উল্লেখ করেছেন। অবধারিতভাবে সেখানে বাদ যায়নি রুদালিদের কথাও। রাজস্থানের এক তথাকথিত উঁচু শ্রেণীর পুরুষ নিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন-
“আমাদের রাজ পরিবারের কেউ মারা গেলে তো কান্নার জন্য একজন লোক চাই, তা-ই না? নারীদের মস্তিষ্ক বিধাতা বানিয়েছেনই এমন করে, যাতে তারা দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলো ভালো করে বুঝতে পারে। তাদের মন খুবই নরম। অন্দরমহলের মেয়েদের তো আমরা বাড়ির বাইরে বের হতে দিতে পারি না। পরপুরুষের সামনে গিয়ে তারা কাঁদলে আমাদের পরিবারের মাথা নিচু হয়ে যাবে। স্বামী মরুক আর বাবা মরুক, আগে তাদেরকে নিজেদের মর্যাদাটা বুঝতে হবে। কাজেই তাদের হয়ে কান্নার কাজটা করে দেয় নিচু জাতের মহিলারা, রুদালিরা। রুদালিদের কান্নায় পুরো গ্রাম বুঝতে পারে তাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সবার দুঃখের প্রতিনিধিত্ব করতেই ডেকে আনা হয় রুদালিদের।”
তাহলে পরিচিত হই রাজস্থানের রুদালিদের সাথে
রুদালিদের কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে লিঙ্গ, জাত, শ্রেণী, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি আগে বিবেচনা করা হয়। যদি কেউ নিচু জাতের হয় আর তার অর্থের খুব বেশি দরকার আছে বলে জমিদার শ্রেণী মনে করে, তাহলে জোর করেও অনেককে রুদালি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়ার নজির আছে। তাদের চোখের পানি এমনই একটি জিনিস, যা খুব সহজে টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে পারে সামন্তপ্রভুরা। মাঝে মাঝে তাই কেউ মারা গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলে হতদরিদ্র এই সম্প্রদায়।
নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে, আবেগ-অনুভূতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের চাহিদামতো চোখের পানি ঝরানো এই নারীদের সমাজে কিন্তু তেমন কোনো দাম নেই। অনেক সময়, অন্নদাতার জবরদস্তিতে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাদের। তাই হাবেলিতে প্রবেশ করা রুদালিদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে কার্পণ্যবোধ করে না সে সমাজ। আর সেই সন্তান যদি হয় মেয়ে, তাহলে বন্ধ হয়ে যায় তাদের সামান্য আয়-রোজগারের পথটুকুও। কেননা রাজস্থানের মানুষের অন্ধবিশ্বাস অনুযায়ী, মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়া রুদালি পরিবার আর সমাজের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। তাই রুদালিদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত একটি প্রবচন প্রচলিত আছে-
‘পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি নায়েক’
কথাটির বাংলা করলে দাঁড়াবে- খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বললেও কষ্ট পাব না, কিন্তু একটি মেয়েসন্তানও যেন ঘরে না আসে। পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেও সেই সন্তান কখনো বাবার নাম ব্যবহার করতে পারে না। কাজেই সমাজের কাছে তারা অচ্ছুত বলেই পরিচিতি লাভ করে। জোরপূর্বক প্রান্তিক করে রাখা এই সম্প্রদায় তাদের যাবতীয় ফরিয়াদ জানায় ‘ভেরুজি’ ভগবানের কাছে। অবশ্য কামপ্রবণ কুমার হয়ে অসংখ্য নারীর ক্ষতি করেছেন ভেরুজি, এই কাহিনী রাজস্থানের প্রায় সবার মুখে মুখেই প্রচলিত আছে। তার শিকারও ছিল সমাজের নিচু জাতের নারীরা। উঁচু জাতের প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাকে তাই রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে কাউকে না চিনেও তার জন্য অঝোরে অশ্রু ঝরাচ্ছে- এই কঠিন কাজের বিনিময়ে তাদের যে অর্থ প্রদান করা হয়, তাকে নামমাত্র মূল্য বললেও কম বলা হবে। আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বেও মরা বাড়িতে গিয়ে কাঁদার জন্য ৫-৬ রূপী করে পেত তারা। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়া, বুক চাপড়ানো, শ্মশান ঘাটে গিয়ে আছড়ে পড়া- এমনি যত কলাকৌশল সেই কান্নার সাথে যুক্ত হতো, ততই তাদের অর্থের পরিমাণ বেড়ে যেত। টাকার সাথে পুরনো কাপড়, ভাত, রুটিও দিত কোনো কোনো দিলদার অন্নদাতা। তবে খাবারের মধ্যে কাঁচা পেঁয়াজ আর বাসী রুটিই বেশি দেয়া হতো তাদের।
কখনো কখনো রুদালিদের টানা বারোদিনও কাঁদতে হয়। যত দীর্ঘদিনব্যাপী শোকের মাতম চলবে, ততই লোকজন ঐ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে কানাঘুষা করবে। পারফরম্যান্স ভালো করতে তাই পেশাদার রুদালিরা নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করার চেষ্টা করে। সবসময় কিন্তু চাইলেই চোখের পানি পড়ে না, তখন শুধু মুখের বিলাপই ভরসা। তবে যারা পুরোপুরি পেশাদার, তাদের নিজস্ব কিছু কৌশল আছে চোখে পানি আনার। কেউ কেউ থুতু লাগিয়ে মুখে পানির রেখা তৈরি করেন, কেউবা এক ধরনের গাছের শেকড় ব্যবহার করেন যা অনেকটা গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। কাজলের মতো এক ধরনের কালিও পাওয়া যায়, যা চোখে লাগানোর সাথে সাথে তীব্র জ্বলুনি শুরু হয় আর চোখের পানি পড়তে থাকে।
ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত ‘রুদালি’ চলচ্চিত্রে খুব বিখ্যাত একটি সংলাপ আছে:
“এই কান্নাই তোর জীবন… গম কেটে যেমন আবার নতুন করে জমি চাষ করতে হয়, তেমনি একবার চোখের পানি মুছে আবার নতুন কারো জন্য চোখের পানি ঝরাতে হয়।”
সে যা-ই হোক, বদলে যাওয়া দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে রাজস্থানিরাও এখন নীরব শেষকৃত্য পছন্দ করে। আধুনিক বিশ্বের চিন্তাধারায় রুদালিদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আর তারা হারিয়েছে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এখন কেবল সময়ই জানে, কত ফোঁটা চোখের পানি তাদের এতো বছরের অন্ন জুগিয়েছে। সূত্র: রোআর বাংলা
বাংলাদেশ সময় : ১৪০০ ঘণ্টা, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ