আল্লাহ আপনাদের সম্মানিত করেছেন মনুষ্যত্বের গুণে। সৃষ্টি করেছেন সঠিক দ্বীনের উপর। শারীরিক সুরক্ষার পোশাক দান করেছেন আপনাদেরকে। সততা, তাকওয়া ও সঠিক পথের বস্ত্র অবতীর্ণ করেছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আপনাদের পিতামাতার সঙ্গে হওয়া শয়তানের ফিতনার কথা। যাতে আপনাদের সামনে পরিষ্কার থাকে শয়তানের দুশমনি ও তার অনিষ্টের স্তূপ। আরো স্পষ্ট হয় তার আনুগত্যের ফলে নেমে আসে কেমন লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা। তার উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে কেন সে সৃষ্টি জগতে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে চায়— যেন তা মানুষের স্বভাবে মিশে যায়। ফলে তারা সে অপকর্মে লিপ্ত হয়েই ক্ষান্ত হয় না; রীতিমতো অন্যকেও তাতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করে একে সুন্দর আবরণে উপস্থাপন করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন— ‘হে আদমসন্তান, আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজসজ্জার বস্ত্র ও তাকওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। হে বনি আদম, শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে; যেমন সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে এমতাবস্থায় যে, তাদের পোশাক তাদের থেকে খুলিয়ে দিয়েছি- যাতে তাদেরকে লজ্জাস্থান দেখিয়ে দেয়। সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখ না। আমি শয়তানদেরকে তাদের বন্ধু করে দিয়েছি, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না। তারা যখন কোনো মন্দ কাজ করে, তখন বলে আমরা বাপ-দাদাকে এমনি করতে দেখেছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জান না। আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তোমরা প্রত্যেক সেজদার সময় স্বীয় মুখমন্ডল সোজা রাখ এবং তাঁকে খাঁটি আনুগত্যশীল হয়ে ডাক। তোমাদেরকে প্রথমে যেমন সৃষ্টি করেছেন, পুনর্বারও সৃজিত হবে। একদলকে পথ প্রদর্শন করেছেন এবং একদলের জন্যে পথভ্রষ্টতা অবধারিত হয়ে গেছে। তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং ধারণা করে যে, তারা সৎপথে রয়েছে।’ (সুরা আরাফ: ২৬-৩০)
প্রত্যেক জাতি ও তাঁর নবীর পেছনে শয়তান ছায়ার মতো লেগে থাকে। তাদের থেকে চতুষ্পদ প্রাণীর ন্যায় নিজের অংশ খেয়ে ফেলে। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য স্বীয় আস্তানা থেকে চেলাদের লেলিয়ে দেয়। তাদেরকে ক্ষমতা, গৌরব, সম্পদ, জনসংখ্যা, প্রস্তুতি ও সরঞ্জামাদির মাধ্যমে আল্লাহর কুফুরি করতে প্ররোচিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘অতপর তারা দেশে দম্ভ করেছিল। কিন্তু তারা জিতে যায়নি। আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচন্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি জুুলুম করার ছিলেন না; কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুুলুম করেছে।’ (সুরা আনকাবুত: ৩৯-৪০)
পাপের ভয়াবহতা ও জঘন্যতা বৃদ্ধি পায় যখন তা করা হয় স্বভাবদাবির বিপরীতে গিয়ে। যেমন, মিথ্যাবাদী শাসক, জিনাকারী বৃদ্ধ, অহংকারী দরিদ্র— কেয়ামতের দিন আল্লাহ এই শ্রেণির সঙ্গে কথা বলবেন না। তাদেরকে শুদ্ধ করবেন না। তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি থাকবে। এদের অবস্থা যখন এমন, তাহলে যে জাতি স্বভাব ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজে অভ্যস্ত তাদের পরিণাম কী! আল্লাহ আমাদের কাছে এর চেয়েও জঘন্য সংবাদ বর্ণনা করেছেন, তা হলো লুত ও ‘সাদুম’ গোত্রের অধিবাসীদের অপকর্মের সংবাদ। তাদের বড় সব কাফের একজোটে এমন অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছে, ইতোপূর্বে কেউ যে কাজে লিপ্ত হয়নি। আল্লাহ বলেন, ‘আর প্রেরণ করেছি লূতকে, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করেনি। তোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে গর্হিত কর্ম করছ? জবাবে তার সম্প্রদায় কেবল একথা বলল, আমাদের ওপর আল্লাহর আজাব আন যদি তুমি সত্যবাদী হও। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা, দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য কর।’ (সুরা আনকাবুত: ২৮-৩০)
আল্লাহ কুফুরির পর কোনো কর্মকে এতটা ঘৃণার চোখে দেখেননি যতটা তাদের সমকামিতাকে দেখেছেন। তাদের এই পাপকর্মে যে নিকৃষ্টতা, নীচতা, নাপাকি, ও লাঞ্ছনার সমাবেশ ঘটেছে, আল্লাহর কিতাবে এমন আরেকটি গুনাহের দৃষ্টান্ত মেলা ভার। এর সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছে ধৃষ্টতা, স্পর্ধা ও নির্লজ্জতা। আজকের যুগেও তাদের অনুসারীদের মাঝে এর ভিন্ন কিছু লক্ষ করা যায় না। প্রত্যেক জাতি উত্তরাধিকার রেখে যায়। আজ তাদের উত্তরাধিকারীরা স্বীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র, কূটচাল ও প্রতারণার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করছে যারা তাদের কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করে, তাদের কৃতকর্ম থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা দেয়। হোক সে কুফুরি কাজে তার মতোই কেউ। আসলে নির্লজ্জতাই তাদের ধর্ম। সে ধর্মে পবিত্রতাই অপরাধ। তাদের পূর্বপুরুষদের বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট— ‘লূত পরিবারকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা শুধু পাক-পবিত্র থাকতে চায়।’ (সুরা নামল: ৫৬)
বক্তব্য এমন একজনকে নিয়ে নয়, যার মাঝে পুরুষত্ব ও নারীত্ব বিরোধপূর্ণ। যার কারণে সে উভয় ক্ষেত্রে সমান বা একাদিক প্রাধান্যযোগ্য কিংবা এ ধরনের ভিন্ন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে সময়ের মহা সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সেসব সমস্যা দূরীকরণে সে যতটা সম্ভব বৈধ উপায় অবলম্বন করছে। কথা মূলত তাকে নিয়ে, যার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সে ভালো কাজ ফেলে জঘন্য কর্মের দিকে ঝুঁকছে। যার ভেতরে নিকৃষ্ট কর্মে লিপ্ত হওয়ার দুর্ভাগ্য প্রাধান্য পেয়ে যায় সে মহা গুনাহে লিপ্ত। জঘন্য অপরাধে জড়িত। তা তার দীন, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র ধ্বংস করে দেয়। স্বভাব বিকৃত করে ফেলে। মুখ ও হূদয়কে কুৎসিত বানিয়ে দেয়।
আর যে সমকামিতাকে উত্তম জ্ঞান করে; বৈধ মনে করে। এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায় মানব-উপকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, সে সরাসরি এতে লিপ্ত না হলেও তা সুস্পষ্ট কুফরি ও খোলাখুলি ধর্মত্যাগ হিসেবে বিবেচিত। শরিয়তের আইন অনুযায়ী তাকে তওবা করতে বলা হবে। অন্যথায় হত্যা করা হবে। যেমনটি ঘটেছে লুত (আ.) এর স্ত্রীর ক্ষেত্রে। একই বিধান প্রয়োগ হবে যদি নারী নারীর সঙ্গে উক্ত কর্মে লিপ্ত হয়।
আল্লাহ আপনাদের অনুভূতিকে আপনাদের কাছে আমানত রেখেছেন। আপনাদের চোখ-কান ও তার প্রভাবাধীন সবকিছুর জন্য আপনাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় বানিয়েছেন। অন্তরসমূহকে আপনাদের বুকে গচ্ছিত রেখেছেন। সেখানে আপনার রব দৃষ্টি দেন। আপনাদের দৃষ্ট ও শ্রুত সব জিনিস অন্তরে খোদাই করে রাখা হয়; বরং স্পর্শকৃত ও আস্বাদিত জিনিসও অঙ্কিত থাকে।
সুতরাং ভেবে দেখুন, কেমন অন্তরে আপনার রবকে স্বাগত জানাচ্ছেন। চিন্তা করুন, আপনার সরল মন কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। অসতর্ক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোন দিকে ছুটে যাচ্ছে। আপনার অন্যমনস্ক জবান কিসে গুনগুন করছে। এসব আপনার অন্তরের জমানো কথা, হূদয়ের আয়না।
আপনাদের অধীনস্থ পরিবার ও সন্তান-সন্ততি প্রতিও লক্ষ্য রাখুন। তাদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল আপনারা। আপনারা এর ভালো-মন্দ প্রতিদান পাবেন। যার ধারণা, সে ছেড়ে দিলে তাকেও ছেড়ে দেয়া হবে— সে মূলত উদাসীন। কারণ পরস্পর দ্বন্দ্বের নিয়মই হলো, যে ধাক্কা দিবে না তাকে ধাক্কা খেতে হবে। যে অন্যকে ধরাশায়ী করবে না সে নিজে ধরাশায়ী হবে। আপনার শত্রু আপনার সম্মতি, দুর্বলতা কিংবা উদাসীনতার খবর আঁচ করতে না পারলে আপনার ওপর দুঃসাহস দেখাবে না। আপনার কষ্টে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ পাবে না।
আমার জানা নেই, আল্লাহর কিতাব ও পূর্ববর্তীদের জীবনবৃত্তান্তে লুত জাতির শাস্তির চেয়ে কঠিন কোনো শাস্তির কথা কোরআনে এসেছে কী না, তাদের মতো এমন অপরাধ, পাপাচার, কদর্যতা ও বিশৃঙ্খলার কথা বর্ণিত হয়েছে কী না! আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর কওমের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার (গৃহ) পানে ছুটে আসতে লাগল। পূর্ব থেকেই তারা কুকর্মে তৎপর ছিল। লুত (আ.) বললেন, হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছে, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কোনো ভালো মানুষ নেই। তারা বলল, তুমি তো জানই, তোমার কন্যাদের নিয়ে আমাদের কোনো গরজ নেই। আর আমরা কি চাই, তাও তুমি অবশ্যই জান। লুত বললেন, হায়, তোমাদের বিরুদ্ধে যদি আমার শক্তি থাকত অথবা আমি কোনো সুদৃঢ় আশ্রয় গ্রহণ করতে সক্ষম হতাম।
মেহমান ফেরেশতাগণ বললেন, হে লুত, আমরা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে প্রেরিত ফেরেশতা। এরা কখনো তোমার দিকে পৌঁছাতে পারবে না। ব্যস, তুমি কিছুটা রাত থাকতে থাকতে নিজের লোকজন নিয়ে বাইরে চলে যাও। আর তোমাদের কেউ যেন পিছনে ফিরে না তাকায়। কিন্তু তোমার স্ত্রী ছাড়া, নিশ্চয় তার ওপরও তা আপতিত হবে, যা ওদের ওপর আপতিত হবে। ভোরবেলাই তাদের প্রতিশ্রুতির সময়, ভোর কি খুব নিকটে নয়? অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছাল, তখন আমি উক্ত জনপদকে উপরকে নিচে করে দিলাম এবং তার ওপর স্তরে স্তরে কাঁকর পাথর বর্ষণ করলাম। যার প্রতিটি তোমার পালনকর্তার নিকট চিহ্নিত ছিল। আর তা সেই পাপিষ্ঠদের থেকে খুব দূরেও নয়।’ (সুরা হুদ: ৭৮-৮৩)
সংবাদ সূত্রঃ মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ